
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আয়া সোফিয়া মসজিদে ৮৭ বছর পর প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির ধর্মীয় বিষয়ক অধিদফতর দিয়ানাতের প্রধান অধ্যাপক ডা. আলী এরবাস এ সময় ইমামতি করেন। তিনি ঐতিহ্য অনুসারে শান্তির প্রতীক তলোয়ার হাতে নিয়ে মিম্বারে খুতবা পাঠ করেন।আয়া সোফিয়া মসজিদটি ১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল বিজয় থেকে ১৯৩৪ সাল জাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৮১ বছর মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ৮৬ বছর জাদুঘর থাকার পর গত বছর ১০ জুলাই আদালতের রায়ের পর ২৪ জুলাই ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত করায় এই প্রথম রমজানের ঈদের নামাজ হওয়াতে মুসল্লিদের খুব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। গত বছর ৮৬ বছর পর প্রথম ঈদুল আজহার নামাজ হয়েছে।
নাগরিকরা যারা ফজরের নামাজ এবং ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করতে চেয়েছিলেন তারা খুব ভোর থেকেই আয়া (হাগিয়া/হাজিয়া) সোফিয়া মসজিদে চলে আসেন। কোভিড-১৯ ব্যবস্থার মধ্যে, সীমিত সংখ্যক লোককে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অনেক নাগরিক মসজিদের আঙিনা এবং স্কোয়ারে অবস্থান নেন।ফজরের নামাজের পর কুরআন পাঠ ও দোয়া করেন ইস্তাম্বুলের মুফতি অধ্যাপক ডা. মেহমেট এমিন মাসালী।অধ্যাপক ডা. আলী এরবাস খুৎবায় বলেন, ঈদের উৎসব সমূহ একই বিশ্বাস, একই ইতিহাস এবং একই সভ্যতার সদস্যদের পারস্পরিক আনন্দ এবং উৎসাহের দিন।তিনি বলেন, ঈদ উৎসবের দিনগুলো ব্যতিক্রমী সময় যা আমাদের অন্তরকে একত্রিত করে এবং আমাদের ভ্রাতৃত্বকে জোরদার করে তোলে,
এটি একতার এক বিরাট দৃশ্য যা সমগ্র বিশ্বজুড়েই ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ গভীরভাবে অনুভূত হয়, যা আমাদের রবের ঘোষণা।তিনি আরও বলেন, আজকের উৎসব আমাদের বিশ্বে কিছুটা বেদনাদায়ক, বেদনা এবং অশ্রু দ্বারা বেষ্টিত। কারণ পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে ইয়েমেন, আরাকান থেকে সিরিয়া পর্যন্ত মুসলিম ভূগোলের নিপীড়িত শহরগুলো থেকে কান্নাকাটি আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আহত করেছে।‘ইসরায়েল পবিত্র শহর জেরুজালেম এবং আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদ আল-আকসা দখল করার প্রয়াসে রমজানের দিনগুলোতে সকল মুসলমানদের জন্য প্রচুর দুঃখ ও বেদনা এনেছে। কারণ, বর্বর উপায়ে মসজিদ আল আকসায় ইবাদত করা মুসলমানদের উপর হামলা করা হয়,
মসজিদের অভয়ারণ্য লঙ্ঘন করা হয় এবং নবী-রাসুলদের স্মৃতিতে অযৌক্তিকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার প্রতীক শহর লুণ্ঠন করা হচ্ছে।’অধ্যাপক ডা. আলী এরবাস বলেন, আমাদের নিরীহ ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের জোর করে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং গণহত্যার করা হচ্ছে। সুতরাং, প্যালেস্তাইন এবং মসজিদ আল-আকসা সম্পূর্ণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি উৎসব দুঃখের সাথে চলে যাবে।‘হযরত মুহাম্মদ (স.) হাদিসে মুসলমানদেরকে দেহের অঙ্গগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং ঘোষণা করেন যে সমস্ত মুমিনকে একজন মুমিনের কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করা উচিত এবং যে মুসলিম নিজের জন্য যা চান তা অন্যের জন্য না চায় সে পরিপূর্ণ মুসলমান না।’ডা. আলী এরবাস বলেন,
প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে পেট ভরে খেয়ে ঘুমানো ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই সমস্ত ন্যায়, নীতি ও মূলনীতি মুসলমান হিসেবে একে অপরের কষ্ট ও আনন্দ ভাগ করে নেয়ার এবং আমাদের ভ্রাতৃত্বকে জোরদার করার জন্য একটি অপরিহার্য দায়িত্ব হিসেবে আমাদের উপর বর্তায়।প্রকৃতপক্ষে, জেরুজালেমের দখল ও নিপীড়ন রোধের একমাত্র উপায়, ইসলামী ভূখণ্ডের শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আরও ভালো ঈদের উৎসব পালন করতে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতিতে কাজ করা।‘অতএব, এই ঈদের উৎসব উপলক্ষ করে আসুন আমরা আমাদেরে ঐক্য, সংহতি এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই হে প্রিয় ভাইয়েরা।’‘মুমিন বান্দা হিসেবে তার জন্য হতাশার কিছু নেই। কারণ, আমাদের পালনকর্তা।
সন্দেহ নাই যে, কঠিনের সঙ্গে অবশ্যই একটি সহজ রয়েছে। সত্যিই কঠিনের সঙ্গে একটি সহজ আছে আয়াতটি দিয়ে আমাদের সুসংবাদ দেন।’খুতবায় আরো বলেন, রমজানে যেভাবে আমরা সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিলাম, আসুন আমরা ঈদে এবং তারপরও আমাদের ভাইয়ের প্রতি আমাদের সাহায্যের হাতটি প্রসারিত করার চেষ্টা করব।উল্লেখ্য, আয়া সোফিয়া মসজিদে তুরস্কে প্রসিডেন্টের পর ক্ষমতাশীন ব্যক্তি পার্লামেন্টের স্পিকার মোস্তফা সেন্টোপ, পরিবহন ও অবকাঠামো মন্ত্রী আদিল ক্যারাইসমেলওলু, ইস্তাম্বুলের গভর্নর আলী ইয়ারলিকায়া এবং ফাতিহ পৌরসভার মেয়র এরগুন তুরানও ঈদের নামাজ আদায় করেন।তুরস্কের পার্লামেন্টের স্পিকার মোস্তফা সেন্টোপ ঈদের নামাজ শেষে পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজায় ইসায়েলের আক্রমণ সম্পর্কে বলেন, এই পরিস্থিতি, এমন একটি চিত্র যা পুরো মুসলিম বিশ্বকে অশান্ত করে তোলে, বিশ্বের প্রায় ২ বিলিয়ন মুসলমানের এই ঈদ উৎসবকে বিচলিত এবং বিষাক্ত করে তুলছে।
তিনি সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও আক্রান্ত মুসলমানদের ঈদের অভিনন্দন জানান এবং কামনা করেন যে এই ঈদ যেন তাদের জন্য বিপর্যয় কাটানোর উপলক্ষ হয়।তিনি মসজিদে আকসাকে তিনটি ধর্মই অন্যতম পবিত্র স্থান উল্লেখ করে বলেন, সবার জন্য এটি উন্মুক্ত রাখা গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। যেটা ওসমানী সাম্রাজ্য করতে পেরেছিল। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে সকল রাষ্ট্রে সকল ধর্মের লোককে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছিল।এজন্য ইহুদীরা ১৪৯২ সালে স্পেনে অত্যাচারিত হয়েছিল, তারা অটোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় নেয়াটা শান্তি ও প্রশান্তির জায়গা হিসেবে দেখেছিল। এখনও ইহুদী নাগরিকরা এখানে শান্তিতে বসবাস করছে।
সুতরাং আমাদের প্রতিবাদ ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয় বরং জায়নিবাদী ইহুদিবাদী, ইসরায়েলীয় মানসীকতার বিরুদ্ধে, যা একটি জায়নিবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে এবং এই অঞ্চলটিকে রক্ত জরিয়ে অত্যাচারের একটি স্থানে পরিণত করেছে।বিশ্বকে, বিশেষত ইসলামী দেশগুলোকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এই মনোভাব, দখল ও নিষ্ঠুর নীতির বিরুদ্ধে একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।