মোহাম্মদ কাইফ তখন ভারতীয় দলে খেলেন। একবার এক আড্ডায় মজা করে বলেন, ‘পাকিস্তানের কাছে হারলে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। সেখানে কেউ ক্রিকেট নিয়ে মাথাই ঘামায় না। তাই গ্রামের বাড়িটাই নিরাপদ।’ শচীন টেন্ডুলকারও কম যান না। ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ ফোঁড়ন কাটেন, ‘বেশ তো ভালোই হলো। আমরাও না হয় কাইফের বাড়িতে দিব্যি দিনকয়েক নিরুপদ্রবে কাটিয়ে দিয়ে আসব।’
ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটযুদ্ধের তীব্র ঝাঁজ বোঝাতে ওপরের দুটি ঘটনার অবতারণা। এক সহকর্মী বলছিলেন, পাক-ভারত ক্রিকেট দ্বৈরথ ‘সব যুদ্ধের জননী’ (মাদার অব অল ব্যাটেল) হলো কী করে। হলো এজন্যই যে, ক্রিকেট মাঠে ওয়াঘা সীমান্তের দুই পড়শি যখন মুখোমুখি হয়, গোটা বিশ্ব ভাগ হয়ে যায় দুই ভাগে। উপমহাদেশের এ দুই প্রতিবেশীর পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব ক্রিকেটে কালো ছায়া ফেলে! তখন যে কোনোভাবে হোক, জয় হয়ে ওঠে মুখ্য। আর সব কিছু গৌণ!
সাতচল্লিশে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে দুটি বিষফোঁড়া রেখে যায়। এক, কাশ্মীর। দুই, ক্রিকেট। শিকড়-বিচ্ছিন্ন মানুষেরা স্থানচ্যুত হওয়ার বেদনা বুকে চাপা দিয়ে রাখেন। ক্রিকেটে পাওয়া জয় তাদের ঈষৎ সান্ত্বনা দেয় জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার যন্ত্রণা থেকে। ক্ষণিকের জন্য পাওয়া সেই সান্ত্বনা যদিও শাস্তিতুল্য। প্রতিবেশীকে হারিয়ে উন্মাদনায় ভাসার আনন্দের মাঝে ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি কোথায়, কে জানে।
জিঘাংসার মনোবৃত্তি থেকেই জয়ের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। ভারত-পাকিস্তান যখনই এই গ্রহের যে কোনো দেশে ক্রিকেটে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়, গোটা পৃথিবী তখনই দুই টুকরো হয়ে যায়। তেরঙ্গা ও সাদা-সবুজের আবেগ কলকাতা কিংবা করাচি, মুম্বাই কিংবা মুলতান-সব জায়গাতেই একই রং ধারণ করে। মোহাম্মদ রফির গানের মতো-তেরে মেরে সাপনে আব এক রাং হ্যায়…।
ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা বিশ্বের যে অংশেই থাকুন না কেন, এই মহারণে তাদের একটাই স্লোগান-‘জিতেগা ভাই জিতেগা…’। মহারণ, রণাঙ্গন-শব্দগুলো ঘুরঘুর করে পাক-ভারত ক্রিকেট দ্বৈরথে। আর বাস্তুচ্যুত হননি, যে কোনো কারণেই হোক, ‘রিফিউজি’ হওয়ার সুযোগ হয়নি, তারাও ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের নীরব সমর্থক হয়ে যান। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের জিন্নাহ সুপার মার্কেটে শালের দোকান পরশমণির বিক্রয়কর্মী ছেলেটি (নাম ভুলে গেছি) যখন জানতে পারে, আমরা পাক-ভারত সিরিজ কভার করতে এসেছি, অদ্ভুত এক আবদার করে বসে। অস্ফুট স্বরে অনুরোধ করে বীরেন্দর সেহওয়াগের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে সেহওয়াগের ভক্ত। তার অটোগ্রাফ চায়। ছেলেটি পাকিস্তানি হিন্দু। কিন্তু ক্রিকেটে তার প্রিয় দল পাকিস্তান নয়, ভারত। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর শহরের রিকশাচালক নাদিম তেমনি চেয়েছিল ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তান যেন জয়ী হয়। অথচ, সে-ও জন্মসূত্রে ভারতীয়। এই গোঁড়ামি, অন্ধ সমর্থন-একে আপনি ক্রিকেটপ্রেম বলবেন, না দেশপ্রেম, সেই সিদ্ধান্ত আপনার!