অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ায় দালালদের হাতে জিম্মি মাদারীপুরের একটি গ্রামের প্রায় অর্ধশত যুবক। মোবাইলে অডিওবার্তা পাঠিয়ে দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালদের লাখ লাখ টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি। প্রশাসন বলছে, দূতাবাসের মাধ্যমে যুবকদের ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হয়েছে পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে জানতে দালালদের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার পর পলাতক অভিযুক্তরা।
লিবিয়ায় দালালদের হাতে জিম্মি যুবকরা হলেন— মাদারীপুর সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের মতলেব ফকিরের ছেলে শাকিব ফকির, বাদশা হাওলাদারের ছেলে হাসান হাওলাদার, সালাম হাওলাদারের ছেলে নুর আলম হাওলাদার, জব্বার হাওলাদারের ছেলে বেল্লাল হাওলাদার, মোক্তার মোল্লার ছেলে জসিম মোল্লা, এনামুল হাওলাদারের ছেলে নয়ন হাওলাদার, সামচু সরদারের ছেলে হৃদয় সরদার, সেকেনদার আলী সরদারের ছেলে সাইফুল সরদার, গোলাম ফারুক সরদারের ছেলে মোস্তাফিজুর সরদার, আমির লাল ফকিরের ছেলে শাহীন ফকির, দুলাল মোল্লার ছেলে আরমান মোল্লা, মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বড়বাড্ডা গ্রামের মনির তালুকদারের ছেলে মুন্না তালুকদার। এ ছাড়া ওমর ফারুক, শুভ ইসলাম, সাব্বির হোসাইন, জুয়েল মৃধাসহ প্রায় অর্ধশত যুবকের নাম রয়েছে এ তালিকায়।
সরেজমিন গেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের যুবক হাসান হাওলাদার। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভাগ্য ফেরাতে অবৈধপথে ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। ঢাকা থেকে লিবিয়া পৌঁছে ধরা পড়েন দালালদের হাতে। পরে বাবা বাদশা হাওলাদার ও মা রহিমা বেগমের মোবাইলে পাঠানো হয় নির্যাতনের অডিও বার্তা। মুক্তিপণ হিসেবে দালালরা দাবি করেন ৩০ লাখ টাকা। সন্তানকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বন্ধক রাখার পাশাপাশি চড়া সুদে দফায় দফায় ২২ লাখ টাকা এনে তুলে দেন স্থানীয় দালালদের হাতে। তবে হাসানের দেশে ফেরা এখনো অনিশ্চিত রয়েই গেছে। বর্তমানে কেমন আছেন এই যুবক জানেন না পরিবার।
একইভাবে বালিয়া গ্রামের প্রায় অর্ধশত যুবক ভাগ্য ফেরাতে ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় জিম্মি দালালদের হাতে। এসব যুবকদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তবু মিলছে না মুক্তি। আদরের সন্তানদের ফিরে পেতে সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন স্বজনরা। স্বজনদের অভিযোগ, প্রলোভন দেখিয়ে বালিয়া গ্রামের রশিদ সরদারের ছেলে দেলোয়ার সরদার প্রত্যেকের পরিবারের কাছ থেকে কৌশলে আদায় করছেন মুক্তিপণের টাকা। তার সহযোগী একই গ্রামের মজিদ ফকিরের ছেলে এমদাদ ফকির ও হাবিব ফকিরের ছেলে কামাল। এ ঘটনায় দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
হাসানের বাবা বাদশা হাওলাদার বলেন, ধাপে ধাপে দালাল দেলোয়ার সরদার ও তার দুই সহযোগী এমদাদ ফকির ও কামাল ফকির এ পর্যন্ত ২২ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রথমে সুদে টাকা ও পরে বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা দিয়েছি। এখন আর টাকা দেওয়ার উপায় নেই। আমার ছেলে এক সপ্তাহ ধরে কেমন আছে, তাও জানি না।
হাসানের মা রহিমা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে দালালরা জিম্মি করে রেখেছে। তারা বিভিন্ন কৌশলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমার ছেলেকে মুক্তি দিচ্ছে না। আমরা আমাদের সন্তানের মুক্তি চাই, আর দালালদের বিচার চাই। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
লিবিয়ায় বন্দি বেল্লাল হোসেন হাওলাদারের স্ত্রী সিগ্ধা আফরোজ বলেন, ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল। এই স্বপ্নটা বাস্তবে রূপান্তরিত হলো না। এটা হবে কিনা সেটাও আমরাও জানি না। আমার স্বামী ৪ মাস আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। পরে লিবিয়ায় দালালরা জিম্মি করে ফেলেছে। তার মুক্তির জন্য এখন পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকা দিয়েছি। ধাপে ধাপে এত টাকা দিলাম, কিন্তু দালালরা মুক্তি দিচ্ছে না। এর শেষ কোথায় আমরা তাও জানি না?
বালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আজিজুল ফকির বলেন, দেলোয়ার দালালের কারণেই এই যুবকরা জিম্মি। এই যুবকদের নির্যাতন করে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে চক্রটি। আমরা সবাই এই দালালের বিচার চাই। আর বন্দি যুবকদের ফেরত চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা নাসিমা বেগম বলেন, এই দালাল দেলোয়ার সরদারের কারণে আমরা দেউলিয়া হয়ে গেছি। দেলোয়ার প্রথমে মিষ্টি কথা বলে যুবকদের লিবিয়া পাঠান, পরে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি এএইচএম সালাউদ্দিন বলেন, লিবিয়ায় কয়েকজন যুবককে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হচ্ছে এমন তথ্য এখনো থানাতে নেই। ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল মামুন বলেন, দুতাবাসের মাধ্যমে লিবিয়ায় বন্দি যুবকদের ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া বন্দি যুবকদের পরিবার মামলা করলে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।