
আরিফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে কত বিচিত্র উপায়ে একের পর এক দখলের ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জনগুরুত্বপূর্ণ খাল ও জলাশয়। এতে বর্ষাকালে পানি প্রবাহের দিক পরিবর্তন হয়ে পড়ায়, এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশে। বেড়েছে
জনদূর্ভোগ। কৃষি কাজে দেখা দিয়েছে সেচ সঙ্কট। আর নৌ চলাচল এখানে নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, এই ভরাটের মহোত্সবের শিকার এখানকার বিভিন্ন এলাকার পরিবেশ রক্ষার পুকুরগুলোও। ইতিমধ্যে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বেশকিছু পুকুর ভরাট করা হয়েছে।
আবার আবাদি কৃষি জমি ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন ভূমি।আর এসব ভরাট ও দখলের বিবরণ জানলে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হতে হয়। প্রতিটি ভরাট ও দখলের পেছনেই থাকে একেকজন খলনায়ক। এখানকার খাল, জলাশয়, নালা দখল করে রমরমা বাণিজ্য কেন্দ্র খুলে বসার তুঘলকি সব
কান্ড-কারখানা খবরের কাগজে মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়। তবে এসবে প্রশাসনের কোনো মাথাব্যাথা নেই। কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপও চোখে পড়ে না। জানা যায়, সরকারি খাল ও জলাশয় ভরাট ও দখলদারদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার কড়া নিদের্শনা রয়েছে বহু আগে থেকেই। এছাড়াও সরকারি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো আবাদি জমির শ্রেণী পরিবর্তন ও পুকুর ভরাটে আইনি নির্দেশনা রয়েছে। অথচ এখানে এসবের কোনো তোয়াক্কাই করছে না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসবে মানা হচ্ছে না সরকার ঘোষিত
নিয়মনীতি। এখানকার ভূমি কর্মকর্তারা এসব ভরাট ও দখলের ব্যাপারে অনেকটা রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জনগুরুত্বপূর্ণ পানি নিস্কাশনের বিশেষ করে খাল
ও নালা দখল করে বিচিত্র সব ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন অনেকেই।স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিস্ট বিভাগ কিছুদিন তৎপর থাকে, তারপর একই অবস্থা। এখানকার জেলা পরিষদের অধীনে থাকা খালগুলো বেশিরভাগই বর্তমানে বেদখল। সরাইল উপজেলা সদর ও আশপাশ জনবহুল এলাকায় বিশাল
এলাকাজুড়ে চলছে কাঠ, বাঁশ, ইট-বালুর ব্যবসা। প্রায়
অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী ছোট গদিঘর তুলে জমিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছেন। জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ নেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের। সদরের জেলা পরিষদ মালিকানাধীন জনগুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান একটি খাল স্থানীয় প্রভাবশালী মহল
সেটি দখল করে মামলা-মোকদ্দমার জাল বিছিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।
সরাইল সদর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী “জাফর খাল” ভরাট ও দখলের কারণে, দীর্ঘ এই খালটি এখন প্রায় মরা
খালে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় লোকদের ভাষ্য মতে, কয়েক বছর আগেও এই খাল দিয়ে নৌকা চলাচল করেছে। এই খালটি উপজেলার পশ্চিম প্রান্ত পানিশ্বর এলাকায় মেঘনা নদী থেকে শুরু হয়ে উপজেলার পূর্বপ্রান্তে শাহবাজপুর এলাকায় তিতাস নদীতে গিয়ে মিশে গেছে। দীর্ঘদিন যাবত
খননের অভাবে ও সম্প্রতি দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অর্থায়নে একাধিক ছোট বক্স সেতু নির্মাণ করায় এই খাল দিয়ে নৌকা চলাচল এখন প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে।
উপজেলার উত্তরাঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী থেকে উঠে আসা আরেকটি ঐতিহ্যবাহী কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ
এ খাল কৃষি প্রধান এলাকা জয়ধরকান্দি ও চাঁনপুর-শাহপুর হয়ে উপজেলা সদর ও প্রশাসনপাড়া ঘেঁষে বয়ে গিয়ে “জাফর খাল” এর সাথে মিশেছে। দীর্ঘ এই খাল এখন পানি নিস্কাশনের নালায় পরিণত হয়েছে। খালটির বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিত ভরাট ও বেপরোয়া দখলদারিত্বের কারণে এই
অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারওপর এ খালের একাধিক স্থানে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অর্থায়নে ছোট ছোট কয়েকটি বক্স সেতু নির্মাণ করার ফলে এই খালে নৌকা চলাচলের প্রতিবন্ধকতা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, একসময় এই খাল দিয়ে বিভিন্ন ভারী ও
মাঝারি নৌযান চলাচল করতো। এতে মালামাল পরিবহন ছিল সাশ্রয় ও সুবিধাজনক। বর্তমানে এই খালে নৌকা তো প্রশ্নই আসেনা, একটি “কলা গাছের ভেলা” চলাও সম্ভব না। দিনের পর দিন দখলের পর ভরাট হয়ে যাচ্ছে এই খাল। এছাড়াও সদরের এই প্রধান দুটি দীর্ঘ খালের সাথে মিশেছে
এমন ছোটবড় বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য খাল ও পানি নিস্কাশনের নালা, এসবের বেশিরভাগই বহু আগেই দখলের পর ভরাট হয়ে গেছে। ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতায় মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, এসব খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুস্ক মৌসুমে সেচ কাজের ভোগান্তির
শেষ নেই। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন স্কীম থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ফলে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, এর প্রভাব পড়ছে কৃষিতে।এদিকে উপজেলার কৃষি প্রধান জয়ধরকান্দি এলাকায় অন্তত শতাধিক একর আবাদি কৃষি জমি ভরাট করে সেইসব জমিতে ভবিষ্যতে আবাসন গড়ার পরিকল্পনা
বাস্তবায়ন করছেন খোদ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। পাশেই তিতাস নদী খননের বালি ও মাটি দিয়ে এলাকার বিভিন্ন কৃষকের কৃষি জমি ভরাট করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই ইউপি চেয়ারম্যান। বিষয়টি আলোচিত ও প্রকাশ্যে হলেও অজানা কারণে প্রশাসন নীরব।অপরদিকে
সদর ও কালীকচ্ছ ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে, একের পর এক পুকুর ভরাট করে, অনৈতিক পন্থায় জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করিয়ে সেখানে বসতভিটা নির্মিত হলেও স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্তাবাবুরা নিজেদের আখেরগুছিয়ে আরাম আয়েশে দিনপার করছেন।
এসব বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অনেকে জানান, এখানকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি বন্ধ হয়ে পড়ছে নৌপথ। এটা ভালো লক্ষণ নই। তারপরও এই যুগে মানুষেরা নৌকা চলাচলে তেমন আগ্রহীও নই। আর খাল দখল এটা একদিনে হয়নি, দীর্ঘ
দিন যাবত চলে আসছে।এদিকে অবৈধ দখলদারদের ক্ষমতার উৎস কী ? এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলেরই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা
চালু রাখে দখল বাণিজ্য। সরকারি জমি জবরদখল করা একটি অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এসব দখলদারের জন্য সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরাধীর রাজনৈতিক
পরিচয় বিবেচনায় না নিয়ে তার অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে আমলে নিয়ে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অন্যায়ের সুরাহা করা গেলে তা শুভ ফলই বয়ে আনবে। তবে সব কিছুর আগে সরকারি সম্পত্তি দখলমুক্ত করা চাই। এ জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। স্থানীয়রা আশা
করেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাবতীয় দখল তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।এ বিষয়ে সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এস এম মোসা জানান, অবশ্যই দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দখল হওয়া খালের জমি পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।