
সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে নিয়ম-নীতি অমান্য করে শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু (এক্সকাভেটর) মেশিনে মাটি কাটা হচ্ছে। এতে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য গ্রামের “কর্মহীন মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থান, স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কর্মক্ষম দুস্থ পরিবারগুলোর সুরক্ষা” কার্যক্রম ভেস্তে যাচ্ছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে উপজেলায় এই কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। গত ২৭ এপ্রিল উপজেলায় এ কর্মসূচির কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এক কোটি ৭৬ লক্ষ ৪৮ হাজার
টাকা বরাদ্দে উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে ৪৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে হতদরিদ্র শ্রমিকের সংখ্যা (তালিকাভূক্ত) দুই হাজার দুইশত ছয়জন। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক দুইশত টাকা মজুরিতে প্রকল্পে সকাল আট’টা থেকে দুপুর দুই’টা পর্যন্ত কাজ করবেন। শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রকল্পে কাজ চলবে। টানা ৪০ দিনের এই কাজে প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি বৃহস্পতিবার নিজের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মজুরির টাকা উত্তোলন করবেন। এক্ষেত্রে যার যার জব কার্ড ব্যাংকে প্রদর্শন করতে হবে।তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই উপজেলায় কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্প বাস্তবায়ন
কাজে কোনো নিয়মনীতি মানছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বরাদ্দের টাকা বাগিয়ে নিতে প্রকল্পগুলোর শ্রমিক তালিকায় স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পে শ্রমিক তালিকায় ইউপি সদস্যের পরিবারের সদস্য সহ নিকট আত্মীয় ও স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শ্রমিকদের জব কার্ড ও মজুরি উত্তোলনের ব্যাংক হিসাবের চেক বই সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে ইউপি সচিবদের কাছে জমা রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় শ্রমিক মজুরির টাকা নিজেরা তুলে নিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ইতিমধ্যে রফাদফা করেছেন বলেও একাধিক সূত্রে
নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর এ কাজে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপ-সহকারি প্রকৌশলী মোঃ সালাউদ্দিন সরাসরি সহযোগিতা করছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির অসাধু ব্যক্তিদের। এদিকে মঙ্গলবার (২৮ মে) উপজেলায় এই কর্মসূচি কাজের বাস্তবায়নের ২৪ তম দিন। অথচ গত তিন দিনে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ৪৪ প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগ প্রকল্পে কোনো শ্রমিক উপস্থিতি নেই। বেশকিছু প্রকল্পে কাজই শুরু করা হয়নি। কিছু কিছু প্রকল্পে শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু মেশিনে মাটি কাটা হচ্ছে। উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের
বিটঘর গ্রামে এ কর্মসূচির প্রকল্প তালিকার ২৪ নম্বর প্রকল্পে কোনো শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়নি। উপজেলায় এ কর্মসূচি শুরুর ১৫ দিন পর, শুধুই এ প্রকল্পের বরাদ্দ ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা বাগিয়ে নিতে ভেকু মেশিনে তিন দিন মাটি কাটা হয়েছে। অথচ এ প্রকল্পে প্রতিদিন ৪২ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, এ প্রকল্পের সড়কে ঘন্টায় দুই হাজার একশত টাকা চুক্তিতে দৈনিক ছয় ঘন্টা করে তিন দিন মাটি কাটা হয়েছে। প্রকল্প সভাপতি ও বিটঘর গ্রামের ইউপি সদস্য মোঃ ইজ্জত আলী প্রকল্পে ভেকু মেশিনে মাটি কাটার কথা স্বীকার করে বলেন,
শ্রমিকের প্রয়োজন নেই, আমার প্রকল্পে মাটি পড়েছে ; সেটিই বড় কথা।ইউনিয়নের বেড়তলা-সিতাহরণ এলাকায় ২৫নং প্রকল্পে ভেকু মেশিনে মাটি কাটাচ্ছেন প্রকল্প সভাপতি। এ প্রকল্পে ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দে প্রতিদিন ৭২ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। প্রকল্প সভাপতি ও বেড়তলা-সিতাহরণ গ্রামের ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, এখন এলাকায় ধান কাটার মৌসুম, তাই দুইশত টাকা মজুরিতে প্রকল্পে শ্রমিক কাজ করতে চায় না। তাই নিজের ভেকু দিয়েই মাটি কাটা হচ্ছে। ৪০দিনের কাজ এই ভেকু মেশিন ৪/৫দিনেই শেষ করবে। প্রকল্পের সকল শ্রমিককে বলা আছে। তারা
কাজ না করেই ঘরে বসে কিছু কিছু টাকা পাবে, সেটাই বড় কথা। কর্মসূচির তালিকার ২৩নং প্রকল্প। বরাদ্দ ২ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা। শ্রমিক সংখ্যা ২৮ জন। তবে এ প্রকল্পে একদিনেও শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়নি। প্রকল্প সভাপতি ও ইউপি সদস্য নিয়াশা মিয়া বলেন, এতো কম মজুরিতে শ্রমিক কাজ করতে চায় না। তাই ভেকু মেশিনে প্রকল্পে মাটি কাটা হয়েছে। প্রকল্পে যেই পরিমাণ মাটি কাটা হয়েছে, তা শ্রমিক দিয়ে সম্ভব নয়। তবে কাজ না করলেও শ্রমিকদের কিছু টাকা দিতে হবে। কারণ মজুরির টাকা তাদের নামে উঠানো হবে তাই। শাখাইতি এলাকায় প্রকল্প নং ২২ এ বরাদ্দ ২
লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা। শ্রমিক কাজ করার কথা প্রতিদিন ৩৬ জন। তবে এ প্রকল্পে কর্মসূচির কোনো শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে না। প্রকল্প সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল আলীম বলেন, দুইশত টাকায় শ্রমিকের কোণাও পাওয়া যায় না। তাই প্রকল্পে ৫০০টাকা মজুরিতে ১০/১২ জন শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এ প্রকল্পের তালিকাভূক্ত শ্রমিক যারা, তারা আমার ভাই-ভাতিজা। তাই ব্যাংক থেকে মজুরির টাকা উত্তোলন কোন ব্যাপারই না।ইউনিয়নের টিঘর গ্রামের প্রকল্প নং ২১। ২ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দে প্রকল্পে প্রতিদিন ২৮ জন শ্রমিক কাজ করার কথা।
অথচ এ প্রকল্পে কোনো শ্রমিক নেই। প্রকল্প সভাপতি ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য নাজমুন নাহার বলেন, এ প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করতে ঘন্টায় ২৫০০টাকা চুক্তিতে ভেকু মেশিন ভাড়া করা হয়েছে। শ্রমিকদের সন্মতিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভেকু মেশিনের ভাড়া পরিশোধ করেও শ্রমিকদের কিছু টাকা দেওয়া যাবে।এদিকে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই কর্মসূচিতে শুধু পানিশ্বর ইউনিয়নের পাঁচটি প্রকল্পেই নয়, উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের বেশকিছু প্রকল্পে শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু মেশিনে মাটি কাটা হচ্ছে। প্রকল্প সভাপতিদের দাবি, শ্রমিক থাকুক আর না-
ই থাকুক, প্রকল্পে মাটি থাকলেই হলো !এ ব্যাপারে পানিশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ দ্বীন ইসলাম তাঁর ইউনিয়নের কর্মসংস্থান কর্মসূচির পাঁচ প্রকল্পেই তালিকাভূক্ত হতদরিদ্র শ্রমিক দিয়ে কাজ না করানোর কথা স্বীকার করে বলেন, এই কর্মসূচি সরকার গরীব মানুষের জন্য চালু করেছে। যারা গরীব মানুষের মজুরির টাকা আত্মসাৎ করতে চায়, তাদের পক্ষে আমি নেই। আমার ইউনিয়নের এসব প্রকল্পগুলোতে মাটি না ফেলা পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো কাগুজে সই করবো না। ভেকু মেশিন দিয়ে প্রকল্পে মাটি কাটা প্রসঙ্গে এই ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, তারা আগে
প্রকল্পে শ্রমিক লাগাননি, তাই এখন ভেকু মেশিনের সাহায্য নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে ভেকু মেশিনে কাজ করার নিয়ম নেই। তিনি বলেন, এই কর্মসূচির শ্রমিক মজুরি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ব্যাংক ম্যানেজার যদি যথাযথ নিয়মে শ্রমিকের টাকা শ্রমিকের হাতে দেন, তাহলে এই কর্মসূচিতে অনিয়মের সুযোগ নেই।