গাজায় আগ্রাসনের শুরু থেকে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননেও মাঝেমধ্যে হামলা করছিল। এখন তারা সে দেশে হিজবুল্লাহর অবস্থানে পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালাতে চায়। কয়েক দিন ধরে ইসরায়েলের সেনানায়কেরা লেবাননকে ‘প্রস্তরযুগে’ পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, হামাসের পাশাপাশি নেতানিয়াহু সরকার এখন আরেকটি যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলবে কি না? তেল আবিবের মুরব্বি হিসেবে ওয়াশিংটনের সরকার সেটার অনুমতি দেবে কি না?
হামাসের মতো হিজবুল্লাহকেও থামাতে চায় আইডিএফ
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে গোলাবারুদ বিনিময়ের ইতিহাস কয়েক দশকের পুরোনো। এবারের দফায় উত্তেজনা তৈরির জন্য ইসরায়েল প্রথম থেকে হিজবুল্লাহকে দোষারোপ করছে। এটা সত্য, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলের দিকে গোলাবারুদ ছোড়া হয়েছিল। সেটা ছিল গাজার প্রতিরোধযুদ্ধের সঙ্গে সংহতি হিসেবে। কিন্তু তার পর থেকে এ পর্যন্ত লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে যত পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই করেছে ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। গত ৯ মাসে তারা লেবাননে পাঁচ শতাধিক মানুষ হত্যা করেছে। তাতেও তৃপ্ত নন আইডিএফের জেনারেলরা।
অন্তত দুটি বিষয় আইডিএফকে লেবাননে পূর্ণাঙ্গ একটা আগ্রাসনে আগ্রহী করে তুলেছে। প্রথমত, গাজা আগ্রাসনকালে বিশ্ব বিবেকের অসহায়ত্ব দেখে হামাসের মতো হিজবুল্লাহর ওপরও বড় আকারে চড়াও হওয়ার এখনই সুবিধাজনক সময় মনে করছে তারা। দ্বিতীয়ত, হামাসের অভিজ্ঞতা থেকে জায়নবাদীরা মনে করছে, হিজবুল্লাহকে আরও শক্তিশালী হতে দেওয়া ভবিষ্যতের জন্য বড় ঝুঁকি হবে।
হাসান নসরুল্লাহ যা চাইছেন
ইসরায়েল একসময় কারণে-অকারণে লেবাননে ঢুকে পড়ত। হিজবুল্লাহর জন্ম সে অরাজকতা থামিয়েছে। লেবানন নিয়ে ইসরায়েলের ছেলেখেলাই হিজবুল্লাহর জন্ম দিয়েছিল। হিজবুল্লাহর উপস্থিতির কারণে লেবাননের সামান্য কিছু ভূমি কেবল ইসরায়েলের দখলে আছে এখন।
এর মাঝের ৩২ বছর হলো হাসান নসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর সাধারণ সম্পাদক। তাঁর দায়িত্বের তিন দশকে হিজবুল্লাহর যুদ্ধক্ষমতা কেবল বাড়ছেই। বিশেষ করে সংগঠনের মিসাইল ভান্ডার এখন বেশ বড়। নানান ধরনের প্রায় দেড় লাখ মিসাইল আছে তাদের অধিকারে। উত্তর ইসরায়েলের অনেকখানি এলাকায় এখন তারা আঘাত করতে পারে।
হিজবুল্লাহর যুদ্ধক্ষমতা বাড়ায় ২০০৬ সালের আগের যুদ্ধে ইসরায়েল মোটেই সুবিধা করতে পারেনি। সেই থেকে নসরুল্লাহ ইসরায়েলকে ‘দুর্বল এক মাকড়সার জাল’ বলে উপহাস করে চলেছেন। কিন্তু গাজাবাসী দেখেছে, ইসরায়েল কী রকম নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে লেবাননে সর্বাত্মক ইসরায়েলি আগ্রাসন নিশ্চিতভাবে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে। তবে সেটা একতরফা না–ও হতে পারে।
হাসান নসরুল্লাহর অধীন হিজবুল্লাহ শক্তিধর এমন এক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যারা প্রকৃতই ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। তা ছাড়া ইসরায়েল মুহূর্তে লেবাননে পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। এ অবস্থা হিজবুল্লাহর পক্ষে কৌশলগত সুবিধা হিসেবে রয়েছে।
নসরুল্লাহও সর্বাত্মক যুদ্ধ চাইছেন বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এ–ও স্পষ্ট, গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি এবং ইসরায়েলকে চাপে রাখার ইরানি নীতির অংশ হিসেবে জায়নবাদীদের শান্তিতে থাকতে দিতে চাইছে না হিজবুল্লাহ।
ইসরায়েলের কেন একটি ‘বানোয়াট বিজয়’ দরকার এখন
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আরেকটি যুদ্ধের খরচ
উত্তর ইসরায়েল ও দক্ষিণ লেবাননে উত্তেজনা বাড়ার মুখে সবার মনে প্রশ্ন, মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য আরেকটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী হবে? হিজবুল্লাহকে আগে থেকে তারা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন মনে করে। সেই সূত্রে নসরুল্লাহর পতনই চায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইসরায়েলের দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ মানেই তাদের বেশি বেশি সহায়তা দেওয়ার প্রশ্ন আসবে।
গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবের সরকারকে ক্রমাগত যেভাবে সহায়তা দিচ্ছে, তাতে নিজ দেশের করদাতাদের মধ্যে মৃদু আকারে হলেও প্রশ্ন আছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনেরও ভরসা এই মানুষদের পকেট। এত দিকে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধের খরচ জোগানো সহজ ব্যাপার নয়। এতে ওয়াশিংটন বৈশ্বিকভাবে ধীরে ধীরে খলনায়কে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু অক্টোবরে ইসরায়েলের ভেতরে হামাস যোদ্ধাদের অভিযান দেখে যুক্তরাষ্ট্র হিজবুল্লাহকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছে। ইসরায়েল যে অজেয় কোনো সামরিক শক্তি নয়, হামাস সেটা প্রমাণ করেছে। হিজবুল্লাহ আগামী দিনে সেটা আরেকবার প্রমাণ করতে পারে।
এ বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’ ৭১০ জন ইসরায়েলি থেকে নেওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে দেখিয়েছে, হামাসের অক্টোবর অভিযানের পাল্টা হিসেবে গাজায় হাজার হাজার মানুষ খুন করা হলেও ইসরায়েলিরা এখনো এক গণট্রমায় আক্রান্ত। এখানকার সমাজজীবনে ৭ অক্টোবর দীর্ঘমেয়াদি এক ‘ডিপ্রেশন’ তৈরি করেছে।
হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলের দিকে হামাসের মতো অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলিদের নিরাপত্তাহীনতার বোধ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এর আরেকটা পার্শ্বফল হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নৈতিক প্রভাব বেড়ে যাওয়া।
এ রকম বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক মহলের বড় অংশ এখনই হিজবুল্লাহর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চাইছে না। বরং লেবানন অভিযানের আগে গাজা যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চেষ্টায় আছে তারা। হিজবুল্লাহও বলছে, গাজায় আগ্রাসন বন্ধ হলেই কেবল তারা উত্তর ইসরায়েলের মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেবে। কিন্তু গাজা যুদ্ধ অবসানের চাবিকাঠি খানিকটা রয়ে গেছে ইরানের হাতে।