
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি;
‘ভোরে স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হয়। এরপর স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করি। সকালে একজন ডাক্তার এসে অপারেশন করেন। সিজারের পর পরই মারা যায় আমার স্ত্রী লাবনী। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে আমার স্ত্রী লাবনীর মৃতদেহ জীবিত দেখিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।’ এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিলেন মারা যাওয়া গৃহবধু লাবনীর স্বামী নাঈম হোসেন। তাদের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার নেপা ইউনিয়নের সেজিয়া গ্রামে।
গত ৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার নেপার মোড়ে ‘একতা ক্লিনিকে’ অপারেশন করার পর মারা যান লাবনী। অপারেশন করেন কথিত ডাক্তার সোহেল রানা। ডাক্তার সোহেল ওই হাসপাতালের মালিক মোহনলালের ছেলে। একইভাবে ১০ আগস্ট রোববার দিবাগত রাতে উপজেলার নেপার মোড়ে মা ও শিশু প্রাইভেট হাসপাতালে সিজারের পর সকালে মারা যান মরিয়াম খাতুন (৩০) নামে আরো এক প্রসুতি। তিনি নেপা ইউনিয়নের জিনজিরা গ্রামের সিকদার আলীর স্ত্রী।এ নিয়ে এক মাসে জেলার হরিণাকুন্ডু ও মহেশপুরে চার ক্লিনিকে চারজন প্রসুতির সৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর জেলা সিভিল সার্জনের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এভাবেই চলছে ঝিনাইদহে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। দুই বছর ধরে ঝিনাইদহের এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গুলোর লাইসেন্স নবায়ন নেই। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ২৩ আগস্ট পার হলেও ঝিনাইদহ জেলার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা তাদের লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র দাখিল করতে না পারায় এমটি হয়েছে বলে জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে জানা গেছে।
অন্যদিকে ক্লিনিক মালিকদের দাবি, তারা সব শর্ত পূরণ করলেও অনলাইনে কাজের সমস্যা হওয়ায় দেরি হচ্ছে। ঝিনাইদহ জেলায় ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৭০ টি। যদিও জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে সে সংখ্যা ৭৯। এরমধ্যে সব থেকে বেশি রয়েছে জেলা সদর ও কালীগঞ্জে। ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন অফিস থেকে জানা গেছে, জেলার ৬ উপজেলায় মোট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১৭০। এর মধ্যে ক্লিনিক রয়েছে ৮১টি। এরমধ্যে কোটচাঁদপুরের একটি ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন আছে।
বাকি ১৬৯টি ক্লিনিকের লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন নেই। তবে লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব ক্লিনিকে চিকিৎসার উন্নত পরিবেশ নেই। নেই সর্বক্ষণিক চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত নার্স। দশ বেডের পরিবর্তে শয্যা বাড়িয়ে ৫০-৬০ জন করে রোগী ভর্তি করা হয়। নির্ধারিত দালালের মাধ্যমে কোনো রোগী পেলে ডাক্তার ভাড়া করে আনা হয়। এর জন্য বাড়তি ফি নেওয়া হয় রোগীর কাছ থেকেই। অপারেশন থিয়েটার দেখলে মনে হবে গৃহস্থবাড়ির রান্নাঘর।
হাতের কাছে সরকারি সেবা থাকতেও প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা সহজ-সরল মানুষেরা এদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। নীতিমালা ভঙ্গ করে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে জনসেবার নামে রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কালীগঞ্জ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানি বলেন, ‘আমরা সরকারের দেওয়া সব শর্ত পূরণ করেছি। কিন্তু অনলাইনে কাজ হওয়ার ফলে নবায়ন সম্পন্ন করতে সময় লাগছে।
’ সমস্যা বিবেচনা করে সময় বাড়ানো উচিত বলে দাবি করেন এই ক্লিনিক মালিক। ঝিনাইদহে সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম বলেন, ‘জেলার কোনো ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন নেই। সব গুলো নবায়নের জন্য অপেক্ষমাণ। কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময়মীমা পার হয়েছে। চাহিদা অনুযাযী ডকুমেন্ট না দেওয়া এসব বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নবায়ন হয়নি। এখন তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবেন তা বলতে পারবো না। ঢাকা থেকে যে সব ক্লিনিকের রিপোর্ট চাওয়া হচ্ছে, আমরা সেগুলো প্রেরন করছি।’