
করোনার কারণে প্রায় সাত মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। তবে বন্ধ নেই মাসিক বেতন আদায়। বেতন আদায়ের জন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান হিসাব শাখা খোলা রেখেছে। কোথাও অনলাইনে এই বেতন পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের তাগাদা দিচ্ছে। এরকমই পটিয়া এলাকার লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কৌশলে বেতন আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের চাপে এখন পুরো সাত মাসের বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে অভিভাবকদের।
করোনাকালে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন, কারো বেতন কমেছে। এই মুহূর্তে তাদের তিনবেলা খাবারের অর্থ আয়ই কষ্টসাধ্য। আবার এরই মধ্যে স্কুলের বেতন পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে নানা শঙ্কায় রয়েছেন অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা। বেতন পরিশোধের বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক উভয়ের জন্য একটি গাইডলাইন দিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এসব পরামর্শ বা গাইডলাইন আমলেই নিচ্ছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ।অভিভাবকদের ভাষ্য মতে, লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়ে এখন বেতন আদায়ের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ কঠোর আচরণ করছে। শিক্ষার্থীদের বেতন ও পরীক্ষার ফি দেওয়ার জন্য আলটিমেটাম দেয়।
গত কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থীদের প্রতি কঠোর হন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তারা পরীক্ষার ফি ও বেতন একসঙ্গে আদায় করছে বলেও জানা যায়।খবর পেয়ে চাপড়া ও দ্বীপকালা মোড়ল তরুণ একতা সংঘ নামের একটি সামাজিক সংগঠন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিতে লাখেরা স্কুল মাঠে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার একটি মানববন্ধন কর্মসূচির আয়জন করেন।সংগঠনের সদস্যদের মতে, তাদের এলাকায় শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ দিনমজুর। করোনার কারণে, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাজ বন্ধ।
এই অবস্থায় স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বেতন ও পরীক্ষার ফি আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে তা সত্যিই অমানবিক কাজের মধ্যে পড়ছে। তারা এই ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন।শিক্ষার্থীদের মতে, স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, কোন কোন শিক্ষার্থী বেতন ও পরীক্ষার ফি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে স্কুলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবেনা বলেও জানানো হয় স্কুল থেকে। এছাড়া তাদের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।এ ব্যাপারে লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সনজীব জানান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমরা কাউকে চাপ প্রয়োগ করিনি। যারা বেতন দিতে পারবেনা, তাদের আমরা চাপ প্রয়োগ করছিনা।
যারা বেতন দিতে পারবে, তারা বেতন দিবে। কারণ, শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টাও আমাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে।স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মফিজ আহমেদ বলেন, আমাদের কমিটি ঘোষিত হয়েছে মাসখানেক আগে। আমরা চাইবোনা আমার এলাকার অবহেলিত মানুষজন শিক্ষাবঞ্চিত হোক। বেতন দিতে না পারলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়া হবেনা বা স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে এরকম কোন কথা কেউ বলবে বলে মনে হয়না। যদি কেউ বলে থাকে, তার বা তাদের বিচার হবে বলেও জানান তিনি।
তবে অবহেলিত এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পাশে তিনি সবসময় থাকবেন বলেও জানান।শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ বা গাইডলাইন কী ছিল:শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ উভয়কে মানবিক আচরণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, এই সময়ে স্কুল বন্ধ আছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, সে কারণেও কিছু খরচ আবার কম। সেই খরচটুকু বাদ দিয়ে বাকি যে খরচ—শিক্ষকদের বেতন, অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেকে পুরো বেতন হয়তো এই সময়ে পাচ্ছেন না, বিশ্বব্যাপী চিত্রটা একই, বাংলাদেশ শুধু একমাত্র দেশ নয়। কাজেই উভয় পক্ষ থেকেই আসলে কিছু ছাড় দিতে হবে।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজেদের কিছুটা হলেও আগামী কয়েক মাস চলার মতো, কোনোভাবে চলার মতো সামর্থ্য আছে, তাদের অনুরোধ করব ফি কিস্তিতে হোক বা কিছুদিন বাদ দিয়ে পরে নেওয়া হোক, সেটি করতে পারলে ভালো। না হলেও দেখেন কতটা ছাড় দেওয়া যায়, সেটা চেষ্টা করবেন।শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ বা গাইডলাইন উপেক্ষিত:শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, বেতন পরিশোধ করতে হবে। আর স্কুল কর্তৃপক্ষকে কিছুটা ছাড় দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই পরামর্শ বা গাইডলাইন মানছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ।
লাখেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক আব্দুল মজিদ সুজন বলেন, ‘আমরা বেতন দিতে চাই। তবে এখন আর্থিক অসচ্ছলতা চলছে। সবকিছু স্বাভাবিক হলে বেতন কিছুটা হলেও কম নেওয়া উচিত। বেতন কিছুটা কমানো হোক। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ বেতন কমানো তো দূরের কথা, বরং করোনার সময়ে সাত মাসের বেতন পরিশোধ না করায় উলটো জরিমানাও করেছে।’কী করছে মন্ত্রণালয়:অভিভাবকদের বক্তব্য, বেতন নিয়ে মন্ত্রণালয় নীরব। মন্ত্রণালয়ের নীরবতায় স্কুল কর্তৃপক্ষ পুরো বেতন আদায় করছে।
গত এক মাস ধরে অভিভাবকেরা বেতন কমানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হলেও তাতে কোনো সাড়া পাননি। শিক্ষামন্ত্রী যেন বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন।অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, বেতন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যই স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের জন্য গাইডলাইন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্কুলগুলো। তাই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এবার নির্দেশনা জারি করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
দরিদ্র অভিভাবকদের জন্য বিশেষ ছাড় দিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হতে পারে।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘অভিভাবকদের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি কমানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন অনুসরণ করছে না এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এ কারণে আমরা একটি নির্দেশনা জারি করব।’তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্ধ চলছে।