তপা, সূচী, ঝুমা- স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ এই তিন বান্ধবী প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে একই রং ও ডিজাইনের শাড়ি কিংবা থ্রিপিস কিনেন। তরুণী থেকে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এ তিন বান্ধবীর বয়স এখন চল্লিশের কোটা পেরোলেও তাদের সেই শখ এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে করোনার কারণে ২০২০-২১ এই দুই বছর তাদের কেনা হয়নি বৈশাখীর পোশাক।
২০২২-২৩ সালে রোজার মাঝামাঝিতে পহেলা বৈশাখ আসায় ওই সময়ও বৈশাখী উৎসবের জন্য আলাদা করে তারা কেউ পোশাক কেনেননি। এবার রোজা শেষে বৈশাখী উৎসব এলেও তা মাত্র ঈদের দুই দিন পর হওয়ায় শখের সঙ্গে সামর্থ্যরে সমন্বয় ঘটাতে পারেননি ওই তিন বান্ধবী।
শুক্রবার মগবাজার আড়ংয়ে একসঙ্গে ঈদের পোশাক কিনতে এসে জানান, ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে এমনিতে সংসার চালাতে হিমশিম। এর ওপর মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দুই উৎসবের জন্য আলাদা করে ছেলেমেয়েসহ পরিবারের অন্যদের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক কেনাকাটা একেবারেই অসম্ভব। তাই শখ থাকলেও বৈশাখী উৎসব উদযাপনের আনন্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
শুধু এই তিন বান্ধবীই নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত অধিকাংশ পরিবারই এবার বৈশাখী কেনাকাটার পুরো বাজেটেই কাঁচি চালিয়েছেন। ঈদ কেনাকাটা শেষে স্বল্প কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে কেউ কেউ পরিবারের কিশোর-তরুণ সন্তানদের জন্য বৈশাখী উৎসবের কেনাকাটা করেছেন। তবে তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে এবারের বৈশাখী বাণিজ্যে ঈদের বড় ধাক্কা লেগেছে।
পোশাকের ব্র্যান্ড শপগুলো থেকে শুরু করে সাধারণ পোশাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, বৈশাখী উৎসব ঘিরে তারা প্রতি বছর লাল-সাদা বা রঙিন থ্রিপিস-শাড়ি, পাঞ্জাবি; টেপা পুতুল, হাতপাখা, গুহাচিত্র, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মোটিফের আলপনা সংবলিত পোশাক তৈরি করলেও গত চার বছরের মতো এবারও কেউ এ ধরনের পণ্যের বড় মজুত করতে সাহস পাননি। অধিকাংশ পোশাক ব্র্যান্ড শপগুলোতে বর্ণিল পোশাকের ‘কালেকশন’ থাকলেও সেগুলো মূলত ঈদকে কেন্দ্র করে তোলা। এছাড়া শাহবাগ মার্কেটসহ বেশকিছু শপিংমলে গত দুই বছরের অবিক্রীত বৈশাখী পণ্য ঝুলতে দেখা গেছে। একেবারে শ্রেফ বৈশাখী উৎসবকেন্দ্রিক পণ্য ব্র্যান্ড শপ আড়ংয়ে দেখা গেলেও তার সংখ্যা একেবারেই সামান্য।
বিক্রেতারা বলছেন, সামনে ঈদ। ক্রেতারা ঈদের পোশাকই খুঁজছেন। হাতেগোনা দু’চারজন ঈদের পোশাক কেনার পর বৈশাখী কালেকশনের কাউন্টারে ঢুঁ মারছেন। সংগ্রহ কিছুটা কম। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৈশাখী পোশাক কেনার কিছুটা আগ্রহ আছে। তাদের অনেকেই বৈশাখী উৎসবের পোশাক খুঁজছেন। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে ‘দেশি দশে’ পোশাক কিনতে আসা এক ক্রেতা বলেন, ‘আমরা বরাবরই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি। এ বছরও পরিবারের সবাইকে বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক কিনে দিয়েছি। তবে বৈশাখী কালেকশন খুবই কম। তাই পছন্দ অনুযায়ী পোশাক কিনতে পারিনি।’
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতির কারণে সামগ্রিকভাবে মানুষের শখের পণ্য কেনার খরচ করার সামর্থ্য কমেছে। তাই সবাই এখন কিছুটা হিসাব করে কেনাকাটা করছে।
বৈশাখী উৎসবের জন্য ব্যবসায়ীরা খুব কম পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করলেও এর এক-তৃতীয়াংশ বিক্রি হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন জানান, প্রতি বছর বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক, জুতা ও অন্যান্য সাজসজ্জার প্রসাধনী বিক্রি হতো ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার। গত চার বছর ধরে এ অঙ্ক অনেক কমে এসেছে। এবারও বৈশাখী পণ্যের বিক্রি কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর কারণ হিসেবে দোকান মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, এবার ঈদের মাত্র দুই দিন পর পহেলা বৈশাখ। এ কারণে এ উৎসবের কেনাকাটায় ক্রেতাদের আগ্রহ কম। এছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্তের সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে। ফলে মানুষের মনে স্বস্তি নেই। এ কারণে বৈশাখের বাজার তেমন জমেনি।’ তিনি অবশ্য মনে করেন ঈদের বাজারও এ বছর খুব জমবে না।
দেশীয় পোশাকের বেশ পুরনো ব্র্যান্ড অঞ্জন’স। প্রায় ৩০ বছর ধরে দেশে পোশাকের ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে অঞ্জন’সের বেইলি রোড শাখার একজন কর্মকর্তার দাবি, ঈদের পাশাপাশি তারা বৈশাখেরও কালেকশন দোকানে তুলেছে। ক্রেতাও আছে। তবে তুলনামূলক কম। কিছু সনাতন ধর্মাবলম্বী ক্রেতা বৈশাখের পোশাক কিনছেন। মুসলমানদের অনেকেই রঙিন পোশাক কিনছেন। যা দিয়ে বৈশাখ ও ঈদ দুটো উৎসবই উদযাপন করা যাবে।
বসুন্ধরা মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা রাজধানীর ডিওএইচএস বারিধারার বায়িং হাউস আরএম গ্রুপের সহকারী হিসাবরক্ষক মৌসুমী ইসলাম জানান, আগে প্রতি বৈশাখে নিজের জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। সঙ্গে ছোট ভাইবোনদের জন্যও কিছু কেনাকাটা করতেন। তবে এবার কারো জন্য তিনি কিছুই কেনেননি। কারণ ঈদ আর পহেলা বৈশাখ খুবই কাছাকাছি। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে এমনিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর ওপর দুই উৎসবের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক কেনাকাটা একেবারেই অসম্ভব। তাই সাধ থাকলেও সাধ্যির সঙ্গে সমন্বয় রাখতে গিয়ে অনেক শখের সঙ্গে এবার বৈশাখী উৎসব উদযাপনের আনন্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
একই অবস্থা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা ফাহমিদা আফরোজের। কারো জন্যই এবার বৈশাখী পোশাক কেনেননি। অথচ নিজের জন্য না পারলেও ছেলেমেয়েদের জন্য পোশাক কেনা হয়নি অতীতের এমন রেকর্ড নেই। তবে ঈদের জন্য কেনাকাটা করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারই এবার বৈশাখী কেনাকাটার পুরো বাজেটেই কাঁচি চালিয়েছেন। নিম্নবিত্তের চোখ থেকেও বৈশাখী উৎসবের স্বপ্ন অনেক আগেই উধাও। তবে আর্থিক টানাটানিতে স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মা, ভাইবোনসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের ঈদ আনন্দ যাতে পুরোপুরি মাটি হয়ে না যায় সে জন্য বেশিরভাগ মানুষ ঈদ কেনাকাটার জন্য কিছু অর্থ হলেও আলাদা করে রাখার চেষ্টা করছেন। কেউবা এরই মধ্যে সাধ্য অনুযায়ী ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রি কিনছেন। খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ বৈশাখী উৎসবের জন্য কেনাকাটা করছেন। তাই এ বছর বৈশাখী বাণিজ্যে কতটা ধস নামবে এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা বৈশাখী উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা সামগ্রি তৈরি করে মজুত করেছেন তারা মহাবিপাকে পড়েছেন।
সরেজমিন রাজধানীর নামিদামি শপিংমল ও বিপণিবিতানের পাশাপাশি নিম্ন-মধ্যবিত্তের বিভিন্ন মার্কেট এবং ফুটপাতের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বৈশাখী পণ্যের কেনাকাটা নেই বললেই চলে। যেসব দোকানে শুধুমাত্র এ উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে অনেকটাই ক্রেতাশূন্য। তরুণ-তরুণীসহ উৎসুক কিছু মানুষ বিভিন্ন জিনিস ঘাটাঘাটি করে দর কষাকষি করলেও কেনাকাটা করছে খুবই কম। এসব দোকানি অনেকে দোকানের নিত্যদিনের খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের রোজার ঈদে আনুমানিক ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। সেবার পহেলা বৈশাখ ঘিরে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকার মতো পোশাক। এবার তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মৌচাক মার্কেটে দোকানি পিয়াল রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। গত এক সপ্তাহে মার্কেটের অবস্থা ভালো না। মানুষের হাতে টাকা নাই। জিনিসপত্রের দামও বেশি। মানুষ খাবে নাকি উৎসবের পোশাক কিনবে?
ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদে নতুন জামা-জুতা, প্রসাধনী কেনার রেওয়াজ বরাবরই ছিল। তবে বৈশাখ ঘিরে নতুন পোশাক কেনার চল মোটামুটি দুই দশকের। প্রথম দিকে তা শুধু উচ্চবিত্তের মধ্যে থাকলেও ফ্যাশন হাউসগুলোর চেষ্টায় নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতারেও তা পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এখন সর্ব শ্রেণির কেনাকাটাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগে পহেলা বৈশাখে সারা বছরের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পোশাক বিক্রি হতো। আর ঈদে বিক্রি হতো ৪০ শতাংশ। এখন কোনো টার্গেটই পূরণ হচ্ছে না।
এদিকে রাজধানীর অন্যান্য মার্কেটের তুলনায় বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের দেশীয় পোশাকের ফ্যাশন হাউস ও শাহবাগ মার্কেটের দোকানগুলোতে বৈশাখী পোশাক কেনার ক্রেতার আনাগোনা বেশি দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর রোজার কারণে এবং ঈদ ও বৈশাখী উৎসব কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে ফ্যাশন হাউসগুলোও পহেলা বৈশাখের জন্য সীমিত পোশাক তৈরি করেছে। মালিকরা বলছেন, বৈশাখের বাজার ধরার যখন প্রস্তুতি নেওয়ার সময়, তার আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বেশিরভাগ পরিবারেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। তাই তারা বৈশাখের উৎসবকেন্দ্রিক পণ্যের দিকে বেশি ঝুঁকি নেননি।
তাছাড়া রোজার কারণে বৈশাখের উৎসব এবার সীমিত হয়ে যাবে, সে চিন্তা থেকেও অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক বৈশাখের আলাদা আয়োজন রাখেননি। যারা বৈশাখের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, টি-শার্ট, কুর্তি, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, কাপ্তান পোশাক তৈরি করেছেন, তারা মাথায় রেখেছেন ঈদের বাজারেও যেন তা চালানো যায়।
অন্যান্য ফ্যাশন ডিজাইনের স্বত্বাধিকারী শবনম রহমান বলেন, রোজার ঈদের বলয়ের মধ্যে থাকায় এবার বৈশাখের আয়োজনটা তুলনামূলক কম। অনেকের ভাবনায় থাকবে যে, একই পোশাক বৈশাখ ও ঈদের জন্য কিনে ফেলব। আবার বৈশাখে শুধু এক দিনের জন্য একটা পোশাক কিনবে কিনা সেটা নিয়েও ভাবছে অনেকে। সেজন্য আমরা টোটাল প্রোডাক্ট লাইন এমনভাবে সাজিয়েছি যেন তা বৈশাখ ও ঈদ দুটোকেই কাভার করতে পারে।
প্রতি বছর বৈশাখের দুই-তিন সপ্তাহ আগেই ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে নববর্ষের পোশাক বিক্রির ধুম পড়ে যেত, এবার সেখানে ক্রেতার উপস্থিতি খুবই কম। এখানকার ফ্যাশন হাউসগুলোতে বৈশাখের পোশাকের সমাহারও অন্য বছরের চেয়ে কম।
এ মার্কেটে কে-ক্র্যাফটের শোরুমে বৈশাখের নতুন ডিজাইনের পাঞ্জাবি, শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ দেখা গেল। দোকানের সেলসম্যানরা জানান, ঈদের পরপরই নববর্ষ পড়ায় বৈশাখের পণ্য অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন তারা। এরও কতটা বিক্রি হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
তবে এ মার্কেটের বেশকিছু দোকানির আশা, খুব বেশি বিক্রি না হলেও বৈশাখী পোশাক বিক্রিতে ততটা ধস নামবে না। এ উৎসবের এখনো সপ্তাহ দুয়েক বাকি। এছাড়া মানুষের হাতে এখনো চলতি মাসের বেতনের টাকা আসেনি। কয়েকদিন পর সরকারি চাকুরেদের হাতে উৎসব ভাতা ও বেতনের টাকা আসলে ঈদ কেনাকাটার পাশাপাশি বৈশাখী বাণিজ্যও চাঙা হয়ে উঠবে। তারা সেই সুসময়ের প্রতীক্ষায় রয়েছেন।