এম. সাদ্দাম হোসাইন সাজ্জাদঃ
বিকাশ থেকে টাকা হাতানোর চক্র ফের সক্রিয় করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সাধারণ ব্যাংকিং সেবা সীমিত করায় গৃহবন্দী মানুষের লেনদেনের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের ব্যবহার বেড়েছে। সেই সুযোগে ফের সক্রিয় হয়েছে ‘বিকাশ প্রতারক চক্র’। বিভিন্ন কৌশলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। প্রতারিত হওয়ার পর বিকাশ কর্তৃপক্ষের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও করছেন ভুক্তভোগীরা। পুলিশের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশেই এই চক্রের সদস্য রয়েছে। তাদের মূল টার্গেট সহজ-সরল মানুষ। এই চক্রের সঙ্গে বিকাশের কিছু অসাধু এজেন্টও জড়িত। তারা বিকাশের গ্রাহকের তথ্য অর্থের বিনিময়ে প্রতারক চক্রের কাছে সরবরাহ করছে।
করোনাকালে এমন প্রতারণার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ৪ নং কুলগাঁও চাপড়া গ্রামের এক দোকানদার। তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাগের ষ্টোর নামে পরিচিত। দোকানদার মো. শহীদুল আলম জানান, গতকাল ১৩ জুন আনুমানিক ৪.৩০ মিনিটের দিকে ডিস্ট্রিবিউশন হাউজ মেসার্স ফয়সাল ট্রেডার্স যার ডিস্ট্রিবিউটর আরিফুল ইসলাম, তাদের বিটের রানা নামের এক এসআর এর ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার(০১৭২৯-০১৫৭১২) থেকে আমার এজেন্ট নাম্বারে ফোন আসে। রানা আমাকে বলেন, একটু পর আপনার নাম্বারে একটা নাম্বার থেকে ফোন যাবে। আপনি রিসিভ করে উনি যা যা বলে তা তা করবেন। আমি রানার কাছে জানতে চাইলাম যে, কোন সমস্যা হবে কি না!
তখন রানা আমাকে উত্তর দেয়, সমস্যা হতে পারে বলেই তো, আপনাকে আগেভাগে সতর্ক করে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে ওই নাম্বার থেকে ফোন আসলে আমাকে ম্যানেজার পরিচয় দেয়। তিনি আমার টাকা দুইটা নাম্বারে(01870781149, 01315942141) ট্রান্সফার করে নেয়। এছাড়া ফোন করে কয়েকটা নির্দেশনা ফলো করতে বলে। আমি ঠিক সেভাবে কাজ করি, কিন্তু হায়, কিছুক্ষণ পর আমি আমার ব্যালেন্স চেক করলে আমার সিমগুলো ব্লক করে দেয়। আমার এজেন্ট নাম্বার থেকে ৬৫ হাজার এবং আমার দুইটা পার্সোনাল নাম্বার থেকে ৩৫ হাজার টাকা সহ সর্বমোট ১ লক্ষ(১,০০,০০০/-) টাকা এ চক্রটি হাতিয়ে নেয়।’
তার কাছে পিন বা নির্দেশনা কেন অনুসরণ করে সেটা জানতে চাইলে তিনি তার প্রতুত্তরে বলেন, ‘আমি তো এসআর রানার ফোন থেকে কল আসছে বিধায় তার কথায় এ কাজ করেছি। আমি সহজ সরল মানুষ। আমাকে রানার নাম্বার থেকে ফোন করা না হলে আমি এই কাজটা করতাম না। আমার সব শেষ! আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম!’পুরো ঘটনা বর্ণনা করে তিনি কালোরপোল পুলিশ ফাঁড়িতে একটি জিডি দায়ের করতে চাইলে, ডিস্ট্রিবিউটর ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতারক চক্রটি আমাদের এসআর-এর মোবাইল নাম্বারটি হয়তো হ্যাক করে এ কাজটি করেছে। এরকম ঘটনা দেশে প্রতিনিয়ত অহরহ ঘটছে। এটা থানায় জিডি করলে এগুলোর সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যায়না।
আমরা আপনাদের আগেই সতর্ক করেছিলাম।’এদিকে ভুক্তভোগী শহীদ জানান, ‘তিনি বিকাশ হেল্পলাইনে যোগাযোগ করেও এর কোন সুষ্ঠু সমাধান পাইনি। তিনি আরো জানান, আমার সব শেষ। কোনরকম সংসারটাই চলছে টেনেটুনে। এ অবস্থায় এ চক্রটাকে ধরা বা টাকাটা উদ্ধার করার জন্য কেউ কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?’বিকাশ প্রতারণার বিষয়টি নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে স্বাভাবিক ব্যাংকিং সীমিত হয়েছে। ফলে মানুষ যথাসময়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে না পেরে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। ফলে প্রতারক চক্র এই সুযোগ নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু করোনার সময় নয়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের চক্র সুযোগ নিয়ে থাকে। যারা পেশাগতভাবেই এই প্রতারণার কাজ করে থাকে। আমরা ইতিপূর্বে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছি। সেই সব অভিযানে চক্রের গডফাদার থেকে শুরু করে তাদের অনুসারী যারা আছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত এক বছরেই এমন সাতটি চক্রের হোতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’বিকাশের লেনদেনের নিরাপত্তাব্যবস্থায় কোনো ফাঁক রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা কয়েক দফায় বৈঠক করেছি। বিকাশের অফিসারদের আমরা ট্রেনিং করিয়েছি, নিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও করে থাকি।
বিকাশের নিরাপত্তার কোনো দুর্বলতার বিষয়টি আমাদের কাছে এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ সহজেই প্রতারণার শিকার হয়ে যায়।’অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে বিকাশের ক্যাশ ইন বা আউট পয়েন্টে গিয়ে অ্যাকাউন্টের যে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সেটি গোপনে করে না। প্রতারক চক্রের সদস্যরা তার আশপাশে থেকে পাসওয়ার্ডটি মনে রাখে। পরে সিম ডেভেলপ করে টাকা তুলে নেয়। সুতরাং, পাসওয়ার্ড কারও সঙ্গে শেয়ার করা উচিত নয়। টাকা তোলার সময় আশপাশে কেউ ফলো করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
গত ২১ মার্চ যশোরে আন্তঃজেলা বিকাশ প্রতারক চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তখন পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, প্রতারক চক্রটি প্রথমে মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন বিকাশের দোকান থেকে তাদের হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে দোকানের বিকাশের রেজিস্টারের পাতার ছবি কৌশলে তুলে নেয়। তারপর ছবিগুলো দ্বিতীয় ধাপের প্রতারকের কাছে পাঠায়। তারা বিকাশের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিকাশ অ্যাকাউন্টের ভেরিফিকেশন কোড ও পিন কোড সংগ্রহ করে। বিকাশ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকের ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতারকরা তাদের নির্ধারিত নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেয়।
সর্বশেষ তৃতীয় ধাপে তারা বিকাশের এজেন্টদের মাধ্যমে সেই টাকা উঠিয়ে থাকে। এজেন্টরা সরাসরি প্রতারণার কাজে সহযোগিতা করে।বিকাশের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রতারণার বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনোভাবেই প্রতারিত হবেন না। ভুলে টাকা চলে গেছে বলে প্রতারক আপনাকে টাকা পাঠাতে বলতে পারে কিংবা বিকাশ কর্মকর্তা সেজে অ্যাকাউন্ট সচল ও তথ্য হালনাগাদের কথা বলতে পারে। এসব কথায় কান দেবেন না। বিকাশ কখনো অ্যাকাউন্টের পিন, ভেরিফিকেশন কোড বা অন্যান্য তথ্য জানতে চায় না। এ ছাড়া আপনি লোভ, ভয় অথবা ভুল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে মোবাইলে অপরিচিত কাউকে নিজের টাকা বিকাশ করবেন না।