মাহমুদুল হাসান:টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
মধুপুর গড় এলাকার আদিবাসী গারো মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত অনাথ সাংমার স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও স্বীকৃতি মেলেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তার পরিবারের। তার ছোট মেয়ে কুটিলা রিচিল বাবার রেখে যাওয়া সেক্টর কমান্ডারের প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে তার বাবার সহযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অভাবের সংসারে তার বাবা যুদ্ধক্ষেত্র ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা ও মধুপুরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। এক বুক আশা নিয়ে শুধু তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য।
মধুপুর উপজেলার ২০১৭ সালে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠিভূক্ত অসুস্থ্য/মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের (সনদ প্রাপ্ত/সনদ বিহীন) জন্য চিকিৎসা সহায়তা এর আওতায় ১৭ জনের তালিকায় প্রয়াত অনাথ সাংমার নাম অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ জন্য চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছেন। অনাথ সাংমা ১৯৮০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরিবারে অভাব আর ছেলে মেয়েরা ছোট থাকার কারণে দীর্ঘ দিনেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে পারেনি তারা।
অনাথ সাংমার সহযোদ্ধা ও তার পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রয়াত অনাথ সাংমা ১৯৪০ সালের ২ জানুয়ারী টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার বেরীবাইদ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে। তার বাবার নাম গেদু সাংমা, মাতার নাম সুনি পান্ত্রা। বেরীবাইদ গ্রাম তৎকালীন সময়ে ছিল গভীর অরণ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেরীবাইদ গ্রামে যেতে গা ছমছম করে উঠতো। তিনি ছিলেন টগবগে যুবক, উঁচু লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। বুকে ছিল অসীম সাহস। দেশ মাতৃকার টানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির লোক হয়েও পাক সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পিছপা হননি। অসীম সাহস নিয়ে ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শত্রুদের পরাস্ত করে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরেন। ওই সময় মধুপুর বন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল। বনের আয়তন ছিল বিশাল। বনের মধ্যে বেরীবাইদ গ্রামে তার থাকার ঘর ছিল ছনের ছাউনি দিয়ে ঘেরা। জীর্ণ ওই ঘরেই পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ডাক পেয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং এর জন্য ভারতে চলে যান। ভারতের ডালু ও তুরাতে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার সহযোদ্ধা জিন্নত আলী জিন্নাহ, রজব আলী, ইমতাজ উদ্দিন, শামছুল আলম, সোহরাফ আলী, আবুল হোসেন, হাবিবুর রহমান, আব্দুল কাদের (যুদ্ধাহত), মতিউর রহমান, আজিজুর রহমান চানু, আব্দুল মান্নান, কেরামত আলী, আব্দুল হাই আকন্দ সহ আরো অনেকের সাথে অনাথ সাংমা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কোম্পানী কমান্ডার রেফাজ উদ্দিন রেফাজের নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টর ছিল তাদের যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধ করেছেন গড় এলাকার রামচন্দ্রকুড়া, ময়মনসিংহের রাঙ্গামাটিয়া, মুক্তাগাছা, ভিটিবাড়ি, বটতলা, কমলাপুর, বিজয়পুর ও মধুপুর। থাকতেন মধুপুর বন এলাকায়।এসব তথ্য অনাথ সাংমার পরিবার ও তার সহযোদ্ধা জিন্নত আলী জিন্নাহ ও রজব আলীর সাথে কথা বলে জানা গেছে।
২০০৯ সালে অনাথ সাংমার স্ত্রী জারি রিচিল শ্বাস কষ্ট রোগে মারা যান। অনাথ সাংমার বড় ছেলে দিনমজুর। স্ত্রী সন্তান সবাই শ্রমজীবী। অন্যের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। অভাবের সংসার তাদের। ছোট ছেলে লিটন রিচিল ইজি বাইক চালিয়ে সংসার চালায়। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে দিন চলে তার। বড় মেয়ে জটিলা রিচিল তিনিও দিন মজুরের কাজ করেন। ছোট মেয়ে কুটিলা রিচিল একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সহায়তাকারী হিসেবে ১৮ বছর যাবত বিনা বেতনে কাজ করেন।
অনাথ সাংমার বড় ছেলে নিলেশ রিচিল জানায়, তারা ২ ভাই ২ বোন । সংসারের অভাব অনটন থাকার কারণে পড়াশোনা ভাগ্যে জোটেনি। ভাই বোনদের ছোট রেখেই বাবা মারা যাওয়ায় তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। জরা জীর্ণ ঘরে বাস করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় ঘরে বাতি দেওয়ার সময় হঠাৎ আগুন লাগায় একমাত্র থাকার আশ্রয় ঘরটিও পুড়ে যায়। পুড়ে যায় আসবাব পত্র ও বাবার স্মৃতি ছবি ও মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র।
কন্যা কুটিলা রিচিল জানায়, অভাবের কারণে অন্যের কাজ করি। বাবার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির জন্য ভাই বোনদের মধ্যে তিনি দৌড় ঝাঁপ পারেন। ২০১৪ সালে বিজ্ঞপ্তি পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। পরবর্তীতে যাচাই বাছাই হয়েছে। এতে তার বাবার সহযোদ্ধারা সাক্ষী দিয়েছেন। বাবার স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ করেন। তার পরিবারের দাবি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার বাবার স্বীকৃতির।
মুক্তাগাছা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও অনাথ সাংমার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নত আলী জিন্নাহ জানায়, ১১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার রেফাজ উদ্দিন রেফাজের নেতৃত্বে আমাদের সাথে প্রয়াত অনাথ সাংমা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমরা এক সাথে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। যাচাই বাছাই কমিটিতে আমরা স্বাক্ষ্য দিয়েছি আশা করি এবার স্বীকৃতি হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে মধুপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিমল কান্তি গোস্বামী জানায়, সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এবার যাচাই বাছাই হয়েছে। আশা করি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম তালিকাভূক্ত হবে।