নজরুলকে ১৯২৯ সালে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি। কলকাতার এলবার্ট হলে (কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত বর্তমান কফি হাউস) ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে (১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯) দুপুর দুটোয় মহাসমারোহে নজরুলকে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে জাতীয় সংবর্ধনা জানানো হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ‘কল্লোল’ ও ‘সওগাতের’- দুই সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। এঁরা দুজনে ছিলেন সংবর্ধনা সমিতির যুগ্ম সম্পাদক।
এ ছাড়া ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, হবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন এস.ওয়াজেদ আলী। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সভাপতি ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রধান অতিথি ছিলেন। দুপুর দুটোয় ফুল-শোভিত মোটর গাড়িতে করে নজরুলকে সভাস্থলে আনা হয়। কবি সভাকক্ষে প্রবেশ করলে সকলে জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা ও সম্মান জ্ঞাপন করেন।
শিল্পী উমাপদ ভট্টাচার্য্য ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে পরিবেশন করেন। ‘নজরুল সংবর্ধনা সমিতির’ সদস্যবৃন্দের পক্ষে প্রদত্ত অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন এস. ওয়াজেদ আলী। পরে অভিনন্দন পত্রটি একটি রূপোর কাসকেটে ভরে সোনার দোয়াত ও কলম সহ কবির হাতে তুলে দেওয়া হয়। সভায় অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা করেন, রায় বাহাদুর জলধর সেন। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর বক্তৃতায় বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে নজরুলের গান গাওয়া হবে, কারাগারেও আমরা তাঁর গান গাইব।তিনি ঘোষণা দেন, যেদিন দেশ স্বাধীন হবে, ভারতবর্ষ যেদিন স্বাধীন হবে, বাঙালীর জাতীয় কবি হবেন কাজী নজরুল ইসলাম।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর বক্তৃতায় বলেন, আধুনিক সাহিত্যে মাত্র দু’জন কবির মধ্যে আমরা সত্যিকার মৌলিকতার সন্ধান পেয়েছি। তাঁরা সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল। নজরুল কবি-প্রতিভাবান মৌলিক কবি। রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবি বলে স্বীকার করেছেন। আজ আমি এই ভেবে আনন্দ লাভ করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমান কবি নন, তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।
কবি মাইকেল মধুসূদন খ্রিষ্টান ছিলেন। কিন্তু বাঙালি জাতি তাঁকে শুধু বাঙালি রূপেই পেয়েছিল। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারে শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।
সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উপসংহারে বলেন, আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করিব। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়িতেছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম, সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি-মানুষে পরিণত হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক-একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।
অপূর্বকুমার চন্দ, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, জলধর সেন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ সমকালীন বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ বিশিষ্ট দার্শনিক, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও মহিলা সভায় উপস্থিত হয়ে নজরুলকে প্রীতি, শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানান। নজরুল সকলের অনুরোধে ‘টলমল টলমল পদভরে বীরদল চলে সমরে’ এবং সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গান গেয়ে শোনান।
নজরুলের অনন্য প্রতিভাষণ সকলকে মুগ্ধ করে-
“বন্ধুগণ!
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটিমাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে, আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম।
এক-বন ফুল মাথা পেতে নেবার মতো হয়তো মাথায় আমার চুলের অভাব নেই কিন্তু এত হৃদয়ের এত প্রীতি গ্রহণ করি কী দিয়ে? আমার হৃদয়-ঘট যে ভরে উঠলো!
সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)
নেতাজির অনুরোধে লিখলেন কাজী নজরুল
কান্ডারী হুশিয়ার
দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার
দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, কার আছে হিম্মত দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, কার আছে হিম্মত কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ কান্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ–মুক্তি–পণ
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ কান্ডারী, আজি দেখিব তোমার মাতৃ–মুক্তি–পণ
“হিন্দু না ওরা মুসলিম”– ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন
কান্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার
নজরুলকে ১৯২৯ সালে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি। দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক মু. আব্দুল হান্নানের এক বক্তৃতা বলেন, ‘১৯২৯ সালে কলকাতার আলবার্ট হলে, নজরুলের যখন ২৯ বছর বয়স, সে সময়ে তাকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছেন, আমি সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি কিন্তু দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মতো কোনো গান আমি খুঁজে পাইনি। এবং তিনি ঘোষণা দেন, যেদিন দেশ স্বাধীন হবে, ভারতবর্ষ যেদিন স্বাধীন হবে, বাঙালীর জাতীয় কবি হবেন কাজী নজরুল ইসলাম।’