আগামী অর্থবছর অন্যান্য অর্থবছরগুলোর মতো নয়। নতুন বাজেটে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সমন্বয় ঘটাতে হবে। সেই সঙ্গে আগে থেকে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকট তো আছেই। পাশাপাশি আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির থাবা। এ অবস্থায় সাধারণ চিন্তা করে বাজেট তৈরি করলে সেটি থেকে ভালো ফল আসবে না। তাই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সতর্কতামূলক বাজেটের বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিদ-উজ-জামান।
এবার নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। তাই উন্নয়নের সঙ্গে রাজেনৈতিক প্রতিশ্রুতিও আছে। কিন্তু অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নাজুক। এছাড়া দীর্ঘসময় ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। আছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। আর্থিক খাত দুর্দশাগ্রস্ত। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুর্বল। পাশাপাশি বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে যে টিম রয়েছে সেটিও একেবারেই নতুন। তাদের প্রথম বাজেট তৈরির অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট হওয়ায় নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। অন্যদিকে অর্থনীতির যে অবস্থা এতে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরির সুযোগ নেই বললেই চলে। সেই সঙ্গে বর্তমানে আইএমএফের একটি কর্মসূচি চলছে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটসংক্রান্ত অঙ্গীকার আছে। আইএমএফ বলছে, বাজেট ‘নিউট্রালিটি’। অর্থাৎ বাজেটের ঘাটতি যে জায়গায় আছে সেখানেই রাখতে হবে। সেটি আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে জিডিপির ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশের মধ্যে বাজেট ঘাটতি রাখতে হবে।
এদিকে বাজেটের প্রত্যাশাগুলো কী? সেগুলো হলো- এমন কিছু করতে হবে যাতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। শোনা যাচ্ছে আগামী অর্থবছরের বাজেট আট লাখ কোটি টাকার হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেট সাত লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো আছে। সেখান থেকে আগামী অর্থবছরে আকার বৃদ্ধির সঙ্গে রাজস্ব আদায় ওই অনুপাতে বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। বাজেট যদি জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ে, তাহলে রাজস্ব আদায়ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারেই বাড়াতে হবে। তাই বাজেটের আকার কতটা বাড়বে সেটি নির্ভর করছে রাজস্ব আদায় কতটা বাড়ানো সম্ভব হবে তার ওপর। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যে অর্থবছর খুব ভালো থাকে সেসময়ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হয় না। তবে এখানে কিছু সুযোগও আছে। আইএমএফ এসব নিয়ে গত এক বছর ধরে কাজ করছে। কোথায় কোথায় বিভিন্ন ধরনের কর অবকাশ সুবিধা কমানো যেতে পারে তার হিসাব নিকাশ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুধু এই জায়গায় সংস্কার করা গেলে জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের অর্ধেক আহরণ সম্ভব। কিন্তু সেখানে বড় প্রশ্ন হলো, কোথায় হাত দিতে পারছেন এবং কতটা দ্রুত পারবেন। সেই সঙ্গে জালে নতুন করদাতা অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। অনেক দিন ধরে বলা হচ্ছে নতুন করদাতা বাড়াতে হবে। অথচ সেখানে কোনো সুফল নেই। আর আছে রাজস্ব খাতের লিকেজ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। এজন্য এখানে সংস্কার দরকার। তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যাবে। বাজেটে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকতে হবে।
আগামী অর্থবছর অন্য চ্যালেঞ্জও যোগ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। যেমন ভোক্তারা চান পরোক্ষ কর কমানো হোক। তাহলে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে। তবে পরোক্ষ কর কমালে আবার রাজস্ব আয় কমবে। এ অবস্থা কিভাবে মোকাবিলা করা হবে সেটি দেখার বিষয়।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়ার যে উদ্যোগ সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে আরও সাশ্রয়ী হতে হবে। কিন্তু গত দুই বছর সাশ্রয়ী হওয়ার কথা বলা হলেও কতটা সাশ্রয় হয়েছে সেটার হিসাব করা হয়নি। আমার ধারণা খুব বেশি কিছু হয়নি। আগামী বাজেটে দেখতে হবে কেন সাশ্রয়ী হতে গিয়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত পর্যায় সাশ্রয় করতে পারিনি। এক্ষেত্রে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এবং ভর্তুকির ক্ষেত্রে যুক্তিকরণ করতে হবে। দেখতে হবে যেসব জায়গায় ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে কিন্তু ফল হয়নি, সেসব জায়গায় ভর্তুকি রাখা যুক্তিসঙ্গত নয়। জ্বালানি ও রেমিট্যান্সের মতো জায়গায় ভর্তুকি কমানোর উপায় খুঁজতে হবে। তবে খাদ্যে অর্থাৎ কৃষিতে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ নেই।
এদিকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে যে বিশাল উন্নয়ন কর্মসূচি থাকতে হবে সেটা নয়। কেননা এটাতে যে মঙ্গল বয়ে আনবে সেটি বলা যায় না। প্রকল্প মানেই হচ্ছে উন্নয়ন কর্মসূচি। তাই নিজস্ব অর্থায়নে করা প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর দিতে হবে।
সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছে। এজন্য দরকার স্মার্ট বাংলাদেশি। তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ কমানোর সুযোগ নেই। বরং বরাদ্দ দিলেও কেন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পারে না সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি এই যুক্তিতে বরাদ্দ কমানোর সুযোগও নেই। বরং বাড়াতে হবে। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য বর্তমানে ঋণ পরিশোধের যে বোঝা এবং আগামীতে এই বোঝা কোন দিকে যাবে তার একটি হিসাব নিকাশ দরকার। বাজেট ঘাটতির আকার নির্ধারণে অনেক কিছুই ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যেটি একেবারেই করা যাবে না, সেটি হলো টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের জোগান দেওয়া। এটা করা হলে ভয়ংকর হবে।
অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘোচাতে হলে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। বাজেট মানে তো শুধু আয় ব্যয়ের হিসাব নয়, সেখানে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সংস্কার কার্যক্রমও থাকা দরকার। আর্থিক, জ্বালানি, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতেও সংস্কার করতে হবে। আগামী অর্থবছর বিদেশি সহায়তার ব্যয় বাড়ানো গেলে ঘাটতি অর্থায়নের সমস্যা হবে না। কিন্তু অর্থ এই খাতের ব্যয়ের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। এজন্য উচ্চাভিলাষী ঘাটতি বাজেট দিলে হবে না। আগামী অর্থবছরের জন্য ফিসক্যাল পলিসির সঙ্গে মনিটরি পলিসির সমন্বয় ঘটাতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন : সাবেক লিড ইকোনমিস্ট বিশ্বব্যাংক, ঢাকা অফিস