চট্টগ্রাম নগর থেকে মাএ ১০ কিলোমিটারের মধ্যেই বোয়ালখালী উপজেলা। কিন্তু ৮৮ বছরের আগের কালুরঘাট সেতু দিয়ে ৩০ মিনিটের এই পথে পার হয়ে চট্টগ্রাম শহরে যেতে কোনো সময় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টাও লাগে বোয়ালখালীর মানুষের।
কর্ণফুলী নদীর ওপর আর একটি নতুন সেতু অনেক পুরনো দাবি তাই ঘুরে ফিরে আসছে
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আলোচনায়।
চট্টগ্রাম-নগরী ৮ আসনের প্রার্থীরাও তাদের ভোটের প্রচারে নতুন একটি সেতুর অঙ্গীকারে কথা দিচ্ছেন।
প্রার্থী জাসদের মঈনুদ্দীন খাঁন বাদল কথা দিয়েছেন, নির্বাচিত হয়ে সরকার ক্ষমতায় আসতে পারলে ১ বছরের মধ্যে নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলে তিনি ‘পদত্যাগ’ করবেন
ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী আবু সুফিয়ানও এ কথা বলেছেন, নির্বাচিত হয়ে প্রথম কাজ হবে নতুন সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা।
মহাজোটের প্রার্থী মঈনুদ্দীন খাঁন বাদল ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী আবু সুফিয়ান
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, মোহরা, পূর্ব ও পশ্চিম ষোলশহর (তিন থেকে সাত নম্বর ওয়ার্ড) এবং বোয়ালখালী পৌরসভা ও উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়ন ছাড়া বাকী ৮ ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম- আট আসন।
৪ লাখ ৭৬ হাজার ভোটারের এই আসনে এবার প্রার্থী মোট ৯ জন। তাদের মধ্যে ৭জন দলীয় এবং ২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদের মঈনুদ্দীন খাঁন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির আবু সুফিয়ান, কাস্তে প্রতীকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির শেহাব উদ্দিন সাইফু, টেলিভিশন প্রতীকে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের এস এম ইকবাল হোসেন, কুঁড়েঘর প্রতীকে ন্যাপের বাপন দাশ গুপ্ত, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. ফরিদ খাঁন, মোমবাতি প্রতীকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের শেহাব উদ্দিন মো. আব্দুস সামাদ এবার ভোটের লড়াইয়ে আছেন।
আর ২ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে এমদাদুল হক সিংহ প্রতীক এবং হাসান মাহমুদ চৌধুরী আপেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ আসনটি ছিল বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। নবম সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাসদ নেতা বাদল নৌকা প্রতীক নিয়ে এ আসনে বাজিমাত করেন।
বিএনপি নেতা প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৯১ সালে এ আসন থেকে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন। সে সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম বিএসসি।
পুরনো এই আওয়ামী লীগ নেতা ১৯৯৬ সালেও নৌকা নিয়ে ভোট করে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে বিএনপির টিকেটে প্রথমবার ভোট করে এমপি হয়ে যান ব্যবসায়ী মোর্শেদ খাঁন।
এরপর ২০০১ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মত এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ৪দলীয় জোট সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মোর্শেদ খাঁন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আবুল কালাম।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মোর্শেদ খাঁন বিদেশে গেলে বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিল এরশাদ উল্লাহকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তাদের মহাজোটের শরিক জাসদের মঈনুদ্দীন খাঁন বাদলকে এ আসনে প্রার্থী করে।
নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করে এ আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের অবসান ঘটান। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
এ বছর বিএনপি মোর্শেদ খাঁন, এরশাদ উল্লাহ ও নগর বিএনপির সহ-সভাপতি আবু সুফিয়ানকে মনোনয়নের প্রাথমিক তালিকায় রেখেছিল। নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত সুফিয়ানই এ আসনে ধানের শীষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এবারও বাদলের ওপর আস্থা রেখে তার হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন
স্থানীয়রা বলছেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনেও কালুঘাটের নতুন সেতু সব দলের প্রার্থীদের আশ্বাসের তালিকায় ছিল। তার পরে আরও দুটি নির্বাচন হয়ে গেছে, গত দশ বছরে চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে নানা প্রকল্পে হাত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বোয়ালখালীবাসীর ভাগ্য খোলেনি।
বোয়ালখালী উপজেলার মানুষকে এখন যে সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসতে হয়, সেটি তৈরি হয়েছিল ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আমলে রেল সেতু হিসেবে। ৭শ গজ দীর্ঘ সেতুটি ১৯৫৮ সালে সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
৯০ দশকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে এই সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে শাহ আমানত সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার ও বান্দরবানের যানবাহন চলাচল বেড়ে যায়।বিভিন্ন সময়ে সংস্কার কাজ করা হলেও সেতুটির অবস্থা এখন নাজুক।
এই সেতু দিয়ে এখন ১সঙ্গে ২ দিকে যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয় না। এক দিকের যানবাহন আটকে রেখে অন্যপাশের গাড়ি ছাড়া হয়। একমুখি চলাচলের এই ব্যবস্থার ফলে প্রতিদিনই যানজটে ভুগতে হয় চলতি পথের যাত্রীদের।
এলাকাবাসী অজানা বাংলাদেশকে জানান সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কালুরঘাটে নতুন একটি ৪ লেইনের সেতুর দাবি পূরণ হয়নি। নির্বাচন এলেই প্রার্থীরা সেতু নির্মাণের কথা বলেন। কিন্তু গত ২ যুগে কোনো সরকারই সেতুর কাজটি শুরু করতে পারেনি।”
এই সেতুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ। মিছিল সমাবেশ মানববন্ধনের মত কর্মসূচিও তারা পালন করেছে বিভিন্ন সময়ে।
এ সংগঠনের আহ্বায়ক আব্দুল মোমিন বলেন, “শহরের এত কাছে বোয়ালখালী। তারপরও শুধু একটি সেতুর অভাবে বোয়ালখালীর স্থায়ী বাসির কাজের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম শহরে এসে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়।”
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন হচ্ছে। সেই লাইনও বোয়ালখালীর ওপর দিয়ে যাবে। সেখানে নতুন সেতু নির্মাণ খুবই জরুরি। সেতু হলে নগরীর ওপর চাপ কমবে। বোয়ালখালী উপজেলার উন্নয়ন হবে।
গত ১০ বছরে সাংসদ হিসেবে বোয়ালখালীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার কথা তুলে ধরে মহাজোট এবার তিনি ‘যে কোনো মূল্যে’ সেতু নির্মাণ করতে চান।
দল সরকারে গেলে আর আমি জয়ী হতে পারলে এক বছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করব। না হলে আমি পদত্যাগ করব।”
বিএনপি প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, কালুরঘাট সেতু নির্মাণ, নদী ভাঙ্গন, নাজুক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন তার প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার।
তবে সবকিছুর আগে আমি জোর দেব সেতু নির্মাণে। নির্বাচিত হতে পারলে সেতু নির্মাণ হবে আমার প্রথম কাজ।