আরিফুল ইসলাম সুমন, স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দুটি এখন নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার, সিএনজি চালিত অটো রিকশা, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক-অটোরিকশা, লেগুণা, মহেন্দ্রা সহ ফিটনেসবিহীন যানবহনের দখলে।জাতীয় মহাসড়কে এসব যান চলাচলে যোগাযোগ মন্ত্রী ও প্রশাসনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উৎকোচের বিনিময়ে আবারো তা চলছে দাপটের সাথে। ফলে এসব নিষিদ্ধ যানের আধিপত্যের কারণে এখানকার মহাসড়কে বাড়ছে দূর্ঘটনা, ঘটছে অহরহ প্রাণহানি।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৫ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিশ্বরোড খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ হোসেন সরকার এ প্রতিবেদককে বলেন, এসব যান মহাসড়কে প্রতিরোধে আমরা চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে তা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।কারণ হিসেবে হাইওয়ে ওসি বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক জেলার আশুগঞ্জ থেকে শশই ইসলাম পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক বিশ্বরোড মোড় থেকে কুটি চৌমুহনী কালামোড়া সেতু পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার এলাকা এই হাইওয়ে থানার অধীনে। সেই তুলনায় এখানে লোকবল ও গাড়ি কম। দরকার দুটি, গাড়ি আছে একটি। নেই সরকারি রেকার। এছাড়া শুধু এখানকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩৩ কিলোমিটারের মধ্যেই ৪৩টি ফিডার রোড রয়েছে। এতো বিশাল এলাকা এই লোকবল দিয়ে
নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এই হাইওয়ে থানায় কনস্টেবল ৩০ জন, দারোগা একজন, সার্জেন্ট একজন, এ এস আই দুইজন, এ টি এস আই একজন, নায়েক দুইজন এবং ওসি পদে একজন রয়েছেন।এদিকে অভিযোগ আছে, এখানকার মহাসড়কে সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, ট্রলি সহ তিন চাকার যানবাহনকে চলাচলের সুযোগ দিয়ে হাইওয়ে পুলিশ টোকেনের মাধ্যমে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এতে এখানকার সড়ক-মহাসড়কে দূর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দীর্ঘ হচ্ছে ‘মৃত্যুর’ মিছিল।
এছাড়াও এখানকার সড়কে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই শুধু হাইওয়ে পুলিশের টোকেন নিয়ে মালপত্র ও যাত্রীবাহী পিকআপ, ট্রাক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লাইসেন্সবিহীন চালকেরা। লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা এসব যানবাহন নিয়ে যত্রতত্র চলে যাত্রী ও মালামাল উঠানামা। ফলে দুর্ঘটনার পাশাপাশি সড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। টোকেনের নামে দেওয়া স্টিকার গাড়ির কাচে সাঁটানো থাকলে গাড়িগুলো চলাচল করতে কোনো সমস্যা হয় না। অন্যথায় চলে নানা হয়রানি। যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের নানা বিরোধের ঘটনাও ঘটেছে এখানে।
এদিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের জেলার আশুগঞ্জের আব্বাস উদ্দিন কলেজ গেট এলাকা থেকে সরাইলের বেড়তলা-শান্তিনগরের সীমানা পর্যন্ত, এখানকার হাইওয়ে পুলিশের ‘স্থায়ী’ ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। দিনে হোক বা রাতে কলেজের সামনে দেখা মিলবেই তাদের। সেখানে দাঁড়িয়ে যানবাহনের কাগজপত্র দেখার নামে চলে চাঁদাবাজি। ফলে পুরো সড়ক থাকে অরক্ষিত।সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার, যানবাহন দুর্ঘটনা, সড়ক পথে মাদকপাচার ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, সড়ক অপরাধ প্রতিরোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ হাইওয়ে পুলিশের মূল কাজ। কিন্তু খাটিহাতা হাইওয়ে পুলিশ আসল কাজ বাদ দিয়ে নানা ফাঁদ পেতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ে বেশি ব্যস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এখানকার হাইওয়ে থানার ওসি হোসেন সরকার বলেন, এসব নিষিদ্ধ যানের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি (শুক্রবার) পর্যন্ত এসব যানের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিগত ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত ১৭৭টি মামলা হয়েছে এখানে। এখানে কোনো প্রকার টোকেন বাণিজ্য হয় না। মাঝেমধ্যে কিছু সিএনজি অটোরিকশা আটক করা হয়। তবে এসবের বিরুদ্ধে পুরোপুরি এ্যাকশন নেওয়া সম্ভব হয় না। এখানকার শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের হুমকি দেয়। এছাড়াও রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের চাপ।
এদিকে সরাইল এলাকার অটোরিকশাচালক রতন মিয়া, আলমগীর হোসেন, কবির হোসেন সহ অনেকে জানান, সরকার মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করার পর আমরাও কিছুদিন বন্ধ রেখেছিলাম। কিন্তু এখন হাইওয়ে পুলিশকে মাসিক হারে টাকা দিয়ে চালাচ্ছি। প্রতি মাসে চাহিদামতো টাকা দিলে মহাসড়কে চলাচল করতে কোনো সমস্যা হয় না। সড়ক দিয়ে মাঝে মধ্যে মন্ত্রী এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা গেলে হাইওয়ে পুলিশ আমাদেরকে আগাম সতর্ক করে দেয়। তখন মহাসড়কে গাড়ি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এলাকার ট্রলিচালক হুমায়ুন মিয়া, আল আমিন, জসিম মিয়া জানান, ‘হাইওয়ে পুলিশ আমাদেরকে কিছুদিন মহাসড়কে চলাচল করতে দেয়নি। কিন্তু মহাসড়কে উঠতে না পারলে আমরা ভাড়া পাই না। ফলে হাইওয়ে পুলিশকে মাসিক ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা করে দিয়ে গাড়ি চালাই।’কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাসচালক সরাইলের সারোয়ার আলম বলেন, ‘সড়কে ট্রলি চলতে দেখলে আমরা নিজেরা ভয়ে থাকি। ব্রেক ও হর্নবিহীন এসব ট্রলি চলে বেপরোয়া গতিতে। ৬-৭ ফুট বডির ট্রলিগুলোতে ৩০-৪০ ফুট লম্বা গাছও বহন করা হয়। এসব গাছ বাঁক পার হওয়ার সময় সহজে অন্য গাড়ির সঙ্গে লেগে যায়। ফলে ট্রলির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আর পুলিশ বৈধ গাড়িগুলোকে নানাভাবে হয়রানি করে। টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ যান চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়।
’আশুগঞ্জ এলাকার মিনি ট্রাক মালিক বাবুল মিয়া বলেন, হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজিতে আমরা অতিষ্ঠ। গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও মাসিক টোকেন নিতে হয়। টোকেন না নিলে অহেতুক হয়রানি করে। তিনি জানান, আব্বাস উদ্দিন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র চেক করার নামে ‘বিশুদ্ধ’ আয় করা হাইওয়ে পুলিশের নিত্যকাজে পরিণত হয়েছে।নিজাম উদ্দিন নামের এক ট্রাকচালক জানান, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলে টোকেনের দাম দেড় হাজার টাকা, আর না
থাকলে দুই হাজার টাকা। সেই বিবেচনায় কাগজ না থাকাটাই ভালো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিবহন শ্রমিক নেতা জানান, খাটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসির মনোনীত এক লোক রেকার নিয়ে সবসময় থানার সামনে থাকে। মাসিক টোকেন না নিলে অনেক সময় গাড়ি পার্কিংয়ে থাকা অবস্থায় পুলিশ গিয়ে রেকার দিয়ে থানায় নিয়ে যায়। তখন গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে গেলে টোকেনের টাকার পাশাপাশি রেকার ভাড়া বাবদ মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। আর রেকার ভাড়ার অর্ধেক টাকা পায় পুলিশ।