
শাফাত রহমান, ঢাবি প্রতিনিধি।
১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্টিত ডাসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ)। প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে ডাকসুর ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) ও জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) সাধারণ ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতো না, হতো পরোক্ষভাবে মনোনীত। ১৯৭০ সালে চালু হয় প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও জিএস হিসেবে মনোনীত হন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান। ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি বেগম জাহানারা আখতার এবং প্রথম নারী জিএস মতিয়া চৌধুরী। সর্বশেষ
ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। সেই বার ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রদলের প্রতিনিধি আমানউল্লাহ আমান এবং জিএস নির্বাচিত হন খায়রুল কবির খোকন। এরপর ডাকসু নির্বাচনের বেশ কয়েকবার আয়োজন করা হলেও তা আর সফল হয়ে উঠেনি। ফলে ছাত্র রাজনীতিতে আজ গতি নেই, নেই মূল্যবোধ। ছাত্র রাজনীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি। হচ্ছে আন্দোলন না করেই নেতৃত্বে যাওয়ার ষড়যন্ত্র। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ডাকসু সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণে রেখেছে প্রশংসনীয় অবদান; অবদান রেখেছে দেশের স্বাধিকার, ভাষা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহেও। ডাকসুর নেতৃবৃন্দের উদ্যোগেই স্বাধীন বাংলায় প্রথম বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ডাকসুর নেতৃত্বস্থানে এসেছেন এমন সব উজ্জ্বল নক্ষত্র যারা
পরবর্তীতে রাজনীতির আকাশকে আলোকিত করেছেন। এই ডাকসুই ছিল বাংলার নেতৃত্ব তৈরীর আঁতুড় ঘর।২০১২ সালে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ২৫ শিক্ষার্থী। ফলস্বরূপ, ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর অনেক জল্পনা-কল্পনা, দেশের শীর্ষস্থানীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বারবার আলোচনার পর আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে ডাকসু নির্বাচন
অনুষ্ঠানে আইনগত কোনো বাধা নেই। অবশেষে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হতে চলেছে। ১১ মার্চ সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলবে।নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনে গঠিত কমিটি ইতিমধ্যে বলেছে, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাইরে যেন প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকে। তবে ‘নিয়মিত শিক্ষার্থী’র সংজ্ঞা সবাই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছে। কারো মতে, যারা ডাকসু ও হল সংসদের ফি দেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধিত শিক্ষার্থী। সে হিসেবে তারা সবাই নিয়মিত। এর মধ্যে একাধিক মাস্টার্স করা শিক্ষার্থী যেমন আছেন, তেমনি সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরাও অন্তর্ভুক্ত থাকেন। আবার কারো মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার পদ্ধতির
নিয়ম অনুযায়ী চার বছরের স্নাতক করতে ছয় বছর এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর করতে দুই বছর সময় বেঁধে দেয়া আছে। এর বাইরে সবাই অনিয়মিত শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নিয়মিত শিক্ষার্থীরা চাচ্ছেন না অনিয়মিত, ইভিনিং শিফট বা অন্য কেউ ভোটার বা প্রার্থী হোক। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পর যারা এমফিল ও পিএইচডি করছেন তাদেরও নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ধরার দাবি জানান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। তবে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের প্রার্থী করার পক্ষে ঢাবি’র উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি মো. আখতারুজ্জামান। ডাকসুর ভোটের মাঠে নামছে কোটা আন্দোলনকারী নেতাদের একটি অংশও। এ গ্রুপটি ইতোমধ্যেই
ভোটার ও প্রার্থীতার ইস্যুতে কথা বলেছে।কিন্তু এই বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন নিয়ে কি ভাবছে ঢাবি’র সাধারণ শিক্ষার্থীরা? কি আশা করছে তারা এই নির্বাচন থেকে? গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে যদি সব দল নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে পারে তাহলে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন থেকে বিভিন্ন পদে নেতা নির্বাচিত হবে। এতে ক্যাম্পাসে সকল ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানের পাশাপাশি একটি ফলপ্রসূ ডাকসু পাবো। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন যেভাবে হলগুলো দখল করে আছে এবং ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য বিস্তার করছে তাতে মনে হয় ডাকসু হলেও কাঙ্ক্ষিত ডাকসু পাওয়া যাবে না।’ যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী লোকমান হাকিম বলেন, ‘ডাকসুর ইতিহাস বলে এটি
সাধারণ শিক্ষার্থী বান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান। আমি আশাবাদী এই নির্বাচন ঢাবি’র সাধারণ শিক্ষার্থীদের এত বছরের অপ্রাপ্তি মেটাতে পারবে এবং কিছুটা হলেও বর্তমান সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।’ নাম প্রকাশ না করা শর্তে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন হলেও কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের চাপে থাকবে ডাকসু।’তবে শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন ডাকসু যে সম্পূর্ণ অনিয়ম মুক্ত ছিল তাও নয়। এক বছর মেয়াদকালের জন্য নির্বাচিত কমিটিগুলোর সিংহভাগই নির্ধারিত সময়সীমার বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে। ডাকসুর গঠনতন্ত্রে প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৩৬ বার এবং স্বাধীনতার ৪৭ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ৭ বার।