আরিফুল ইসলাম সুমন, সরাইল থেকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে সালিশের রায় না মানায় একটি সংখ্যালঘু পরিবারকে ২৮ মাস ধরে একঘরে করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ও বুড্ডা গ্রামের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছে পরিবারটি। সরেজমিন বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের বুড্ডা গ্রামের সুধন মাঝির মেয়ে রুনা রাণী মাঝি একই গ্রামের উষা রঞ্জন দাসের বিবাহিত ছেলে নির্মল চন্দ্র দাসের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তারা
পরিবারকে না জানিয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেলেন। একপর্যায়ে রুনা রাণী মাঝি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। এ ঘটনা প্রায় আড়াই বছর আগের।
পরে বিষয়টি নিয়ে এলাকায় মুখরোচক আলোচনার সৃষ্টি হয়। নির্মল দাসের প্রথম স্ত্রী রত্না রাণী দাস ও তাদের পরিবার বিষয়টি নিয়ে সালিশ বসান।
গ্রামের ইউপি সদস্য অলি আহাদের বাড়িতে বসা এ সালিশে গ্রামের মাতব্বররা উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ কাজল চৌধুরী। সালিশে এইভাবে গোপন সম্পর্ক করে
বিয়ের কারণে অভিযুক্ত রুনা মাঝি ও নির্মল দাসের অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয় তাদের পিতা সুধন মাঝি এবং উষা রঞ্জন দাসকে। সুধন মাঝিকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা সহ তার পরিবারকে দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রাখার রায় হয়। পাশাপাশি উষা রঞ্জন দাসকে পরিবার সহ দুই বছর ‘একঘরে’ করা সহ তার বসতভিটার দুই শতক জমি নির্মলের প্রথম স্ত্রী রত্না রাণী দাসের নামে লিখে দেয়ার রায় আসে। এই রায় ঘোষণা করেন সালিশের সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী।
সুধন মাঝি বলেন, আমার মেয়ে রুনা গোপনে সম্পর্ক গড়ে কখন নির্মল দাসকে বিয়ে করে, এসবের আমি কিছুই জানতাম না। মেয়ে আমার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি টের পাই। অন্তত ২৮ মাস আগে এ সালিশ হয়। সালিশের সপ্তাহখানেক পর রুনা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। হৃদয় নামে ওই ছেলের বয়স এখন প্রায় আড়াই বছর। গ্রামের মাতব্বরদের চাপে রুনা তার স্বামী নির্মল ও শিশু পুত্র হৃদয়কে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
সুধন মাঝি চোখের পানি মুছতে মুছতে এই প্রতিবেদককে বলেন, ওই সালিশে আমার মেয়ের অপরাধে ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী আমাকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করেন এবং দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রায় দিয়ে যান। চেয়ারম্যানের দেওয়া দুই বছরের সাজা আজ দীর্ঘ ২৮ মাস যাবত খাটতেছি। এই ২৮টি মাস আমি আমার পরিবারের লোকদের নিয়ে বুকে পাথর বেঁধে পার করেছি। সমাজের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউই আমার পরিবারের লোকদের সাথে মনখুলে কথা বলেন না। গ্রামের ধর্মীয় সহ কোনো আচার অনুষ্ঠানে আমাদেরকে দাওয়াতও দেয় না, এমনকি এসবে অংশগ্রহনেও বাধা দেয় মাতব্বররা।
কিছুদিন আগে চেয়ারম্যানের দুই পা ধরে অনেক কেঁদেছি। তখন চেয়ারম্যান গ্রামে এসে জানিয়ে গেছেন “সুধন মাঝিকে দেওয়া দুইবছরের সাজার মেয়াদ, চারমাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সবাই সুধন মাঝিকে ক্ষমা করে দিয়ে সমাজে তোলে নেন।” চেয়ারম্যানের এই কথার পরও মাতব্বররা আমাদের ‘একঘরে’ রাখা সাজা মওকুফ করছেন না। তাই আর পারছি না, হয় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করবো, না হয় পরিবারের সকলে বিষপানে আত্মহত্যা করবো। বিষয়টি জানাতেই আজ (১৩ ফেব্রুয়ারি) উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ঢুকতে রওয়ানা হয়েছিলাম। কয়েকজন লোক বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়ে আমাদেরকে ফিরিয়ে আনেন।
সুধন মাঝির স্ত্রী গৌর রাণী মাঝি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলেন, চেয়ারম্যান ও মাতব্বরা এই সাজা দেওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলেকে বিয়ে করাতে পারছি না। আমার বাড়িতে কোন পূজারী আসেন না। ধর্মীয় কাজে নানা বাধা। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা গ্রামের কারো ঘর-বাড়িতে যেতে পারে না। ২৮ মাস যাবত পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে জেল খাটতেছি। জানিনা চেয়ারম্যানের দেওয়া এই কলঙ্কময় এই সাজা কবে শেষ হবে।
গ্রামের সালিশকারক মোঃ শামীম মিয়া বলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে ওই সালিশে আমিও ছিলাম। কিন্তু এই রায়ে আমি তখন একমত ছিলাম না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাতাব্বরদের নিয়ে আলোচনা করে ইউপি চেয়ারম্যান এ রায় দেন। এই রায় অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাছাড়া চেয়ারম্যান ও মাতব্বররা দুইজনকে সাজা দিলেও সালিশ হওয়ার ১০ দিনের মধ্যে গ্রামের মাতব্বররা উষা রঞ্জন দাসকে ক্ষমা করে সমাজে তোলে নেন। এর কিছুদিন পর উষা রঞ্জন দাস মারা যান।কিন্তু সুধন মাঝি ও তার পরিবার ২৮ মাস যাবত এই সাজা ভোগ করে আসছেন।
গ্রামের দিপু দাস, নান্টু চন্দ্র দাস, মোঃ শাহজাহান মিয়া, বিশ্ব চন্দ্র দাস সহ অনেকে জানান, আড়াই বছর আগের ওই সালিশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন, ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী, ইউপি সদস্য অলি আহাদ, গ্রাম্য মাতব্বর রঞ্জিত দাস, লালমন দাস, লক্ষী মাস্টার, স্বপন দাস, ফানু দাস, হরিমন দাস সহ কয়েকজন সর্দার। সালিশে রায় ঘোষণা করেন ইউপি চেয়ারম্যান। এই রায়ের পর থেকে গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান কেউই সুধন মাঝির পরিবারের সাথে কথা বলে না। তাদের সাথে কোনো সম্পর্কও গড়ে না।
সালিশে উপস্থিত লক্ষী মাস্টার ওই রায়ের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা নই, চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী এ রায় দেন, তবে এ রায়ে আমাদের সমর্থন ছিলো এবং এখনো আছে। তিনি বলেন, উষা রঞ্জন দাস সালিশের রায় মেনে বাড়ি থেকে দুই শতক জায়গা লিখে দেওয়ায় তাকে আমরা সমাজে তোলে নিয়েছি। তাছাড়া তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু সুধন মাঝির কোনো ক্ষমা নেই। চেয়ারম্যান যা করে দিয়ে গেছেন, তা-ই ঠিক থাকবে। সুধন মাঝির পরিবার ‘একঘরে’ থাকবে।
নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী বলেন, দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রাখা হয়েছিল সুধন মাঝির পরিবারকে। সালিশে হিন্দু মাতব্বররা জুরিবোর্ড করে এই রায় তারা ঠিক করেছিল। আমি সালিশের সভাপতি ও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিস্থিতি সামাল দিতেই এ রায় ঘোষণা করি। তবে আমার দেয়া রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গ্রামের মাস্টার বাড়ির লোকেরা সুধন মাঝিকে সমাজে তোলতে চাইছেন না।