
স্টাফ রিপোর্টার।।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন মাদকের গডফাদাররা। ঢাক ঢোল পিটিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ অভিযান সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু করার পর চিহ্নিত অনেক মাদক গডফাদার গা-ঢাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন তারা আপাদত এলাকায় অথবা এলাকার বাইরে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের উপায় খুঁজছেন। অনেকে ইতিমধ্যে এলাকা ছেড়েছেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ নিজ এলাকায় ভিন্ন প্রন্থায় মাদক বিক্রি অব্যাহত রেখেছেন। পাশাপাশি চলমান পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানেও থেমে নেই ইয়াবার প্রবেশ। এখনো এগুলো ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলার বিভিন্ন স্পটে।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৌশল বদল করে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তবে অভিযানের কারণে ইয়াবার দাম আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। শুধু সেবনকারী নয়, মাদকের গডফাদারকেও আইনের আওতায় আনা হবে। সে যত বড় শক্তিশালী হউক না কেন ? এইবার মাদকের সাথে জড়িতদের রক্ষা নেই। ওসি মফিজ উদ্দিন আরো বলেন, মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) পুলিশের বিশেষ অভিযানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়। কয়েকটি মাদক আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ।
এদিকে সরাইল সার্কেল এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মনিরুজ্জামান ফকির মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে মাঠে বিভিন্ন অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খোদ এই পুলিশ কর্মকর্তা। এ কাজে তিনি সকল পেশার মানুষের সহযোগিতাও চেয়েছেন।অপরদিকে সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এস এম মোসা উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে মাদকের সাথে জড়িতদের নামের তালিকা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে প্রশাসন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, চলমান অভিযানের ন্যায় কিছুদিন আগেও এখানে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান হয়। এতে গ্রেফতার হন বেশকয়েকজন মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। মামলা হয়েছে কয়েকটি। ‘মাদক ব্যবসায়ীদের দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এর পরও এখানে ইয়াবা চক্রের শক্ত নেটওয়ার্ক ভাঙা সম্ভব হয়নি। রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। মাঝে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকলেও র্যাব ও পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ রকম শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী
পলাতক থেকে, কেউ কেউ জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের আগে গোয়েন্দা সংস্থা পৃথকভাবে তালিকা তৈরি করে। এসব তালিকা যাচাই -বাছাইয়ের পর এখন পুলিশের হাতে রয়েছে। এই তালিকায় নিয়মিত সেবনকারী, মাদক ব্যবসায়ী ও মদদদাতাদের নাম রয়েছেন। এরমধ্যে অন্যতম হিসেবে পুলিশের তালিকায় নাম আছেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী ক’জন নেতা। পাশাপাশি এ তালিকায় স্থানীয় প্রভাবশালী কথিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধির ছেলে,
ভাতিজা ও ভাইয়ের নামও রয়েছে। তারাই মূলত এখানকার মাদকের গডফাদার হিসেবে ভূমিকা রাখছেন ভিন্ন কৌশল খাটিয়ে। ওয়াকিবহালরা মনে করছেন, জেলার বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা আখাউড়া, বিজয়নগর ও কসবা এলাকা থেকে ইয়াবার চালান আসা পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলে এখানে মাদক রোধ করা সম্ভব নয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতা ছাড়া মাদকের চালান সীমান্ত থেকে সরাইলের অন্যান্য জায়গায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের
অসাধু সদস্যরা মাদক ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে এমন অভিযোগ উঠছে। ধরাও পড়ছেন কেউ কেউ। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তেমন কোনো লাভ হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা কঠোর না হলে মাদক প্রবেশ কিংবা ব্যবসা ঠেকানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অভিযানও হবে ‘চোর-পুলিশ’ খেলার মতো। তারা আরও বলছেন, অনেক এলাকায় মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নামও উঠে এসেছে। এখন মাদক ঠেকাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাতেই শুদ্ধি অভিযান দরকার।
এ বিষয়ে প্রশাসনের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (অব.) এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘শর্ষের ভিতরে যদি ভূত থাকে তাহলে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যই সফল হবে না। একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য মাদকই যথেষ্ট। ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদক কোথা থেকে আসছে, কোন পয়েন্ট দিয়ে আসছে তা তো এখানকার সবকটি সংস্থা এমনকি থানাপুলিশ পর্যন্ত অবগত। সরকারের এই সাবেক আমলা পরামর্শ দিয়ে বলেন, এখানে সকল কিছুর উর্ধ্বে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সাঁড়াশি অভিযান কঠোরভাবে পরিচালনা করা উচিত। যতদিন পর্যন্ত না ইয়াবার প্রবেশ বন্ধ
সহ এর নেপথ্যে যারা তারা গ্রেফতার হবে, ততদিন পর্যন্ত ওই সাঁড়াশি অভিযান পুলিশ সদস্যরা চালিয়ে যাবেন। তিনি আরও বলেন, মাদক নির্মূলে পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হলে, অনেক নেতা তদবির শুরু করে দেন। এটা তো কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ হতে পারে না। একই সঙ্গে মাদক মামলায় ও গ্রেফতারে পুলিশ আরও কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। উল্লেখ্য, ঘোষণা দিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সরাইলে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে পুলিশ। একদিনেই অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে। তবে এদের
বেশির ভাগই নিচের পর্যায়ের, কেউ কেউ মাঝারি পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী। এর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ উপজেলার মাদক স্পট ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন পেশার যেসব ব্যক্তি অনৈতিক সুবিধা বা মাসহারা নেন তাদের তালিকা তৈরি করে। এ তালিকায় মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়দাতাদের নামও উঠে আসে। যদিও তার সিকিভাগও আইনের আওতায় আসেনি। ফলে মাদক স্পটগুলো থেকে তাদের মাসহারা আদায়ও অব্যাহত রয়েছে। এ তালিকাটি পুলিশের কাছে রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এখানকার পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যদি কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তথ্য প্রমাণ পেলে তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার করা হবে। এখানে পর্যায়ক্রমে মাদক অভিযানে আরও পরিবর্তন আসবে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী গা-ঢাকা দিয়েছেন। মাদকবিরোধী অভিযানের কারণেই এসব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে।’ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী সে যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এখানে কে ছোট, কে মাঝারি আর কে গডফাদার— তাদের কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’