বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ফায়ারম্যান সোহেল রানার প্রথম জানাজা নিজ দফতরে সম্পন্ন হয়েছে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তার সহকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ও তার ছোট ভাই।আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের
ফুলবাড়িয়ার সদর দফতরে তার এ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।জানাজায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন, সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান, পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহীম খান, এনটিএমসির ডিজি জিয়াউল আহসান
উপস্থিত ছিলেন।এর আগে সকালে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমইএচ) মর্চুয়ারিতে থেকে সদর দফতরে আনা হয় সোহেলের লাশ। জানাজার পর সহকর্মীদের শ্রদ্ধা শেষে লাশ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনায় নেয়া হবে !২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধারে অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। ২৩
তলা ওই ভবনে আটকে পড়া মানুষকে ল্যাডারের মাধ্যমে নামাচ্ছিলেন তিনি। নিজের জীবন বাজি রেখে একের পর এক মানুষকে উদ্ধার করে নিচে নামাচ্ছিলেন। সে সময়ে ভবনের ভেতরেটা আগুনের লেলিহানে আরো উতপ্ত হয়ে উঠছিল। মানুষ জানালার গ্লাস ভেঙে মাথা বের করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। জীবন বাঁচাতে নিচে লাফ দেয় অনেকে। এ
পরিস্থিতিতে সোহেল চার-পাঁচজন আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিচে নামাতে চান। উদ্ধারকারী ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত সিঁড়ি নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। তাই ল্যাডারের ওজন কমাতে একপর্যায়ে সোহেল নিজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ল্যাডার থেকে বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। এরপরই
ঘটে দুর্ঘটনা, যা তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিলো। ল্যাডারের ভেতরে সোহেলের একটি পা ঢুকে যায়। এ সময় তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। এরপর থেকেই সংজ্ঞাহীন সোহেল।দুর্ঘটনার পরপরই সোহেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রতিদিন
চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছিল না। পেটের ক্ষতের কারণে সমস্যা হচ্ছিল রানার। সিএমএইচের চিকিৎসকদের পরামর্শে গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সোহেল রানাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট)
চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।মৃত্যুর খবরে সোহেলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা হালিমা খাতুন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। কৃষক বাবা নুরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ। বড় বোন সেলিনা আক্তার করছেন বিলাপ। শুধু পরিবারের লোকজনই নন, এলাকাবাসীও যেন নিথর হয়ে গেছে তার এই মৃত্যুতে।
সোহেলের মৃত্যুর খবরে রাতেই এলাকার লোকজন তাদের বাড়িতে এসে ভিড় জমায়। সকাল থেকে দূর-দূরান্তের মানুষ এসে ভিড় করছেন তাদের বাড়িতে।সোমবার বিকেলে সোহেলের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কিছুতেই কান্না থামছে না সোহেল রানার মা হালিমা
খাতুনের। চার দিকে কান্নার রোল। প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে বুক চাপড়ে মাতম করছেন ছোট দুই ভাই ও একমাত্র বোন। এমন একজন পরোপকারী ও ভালো মানুষের মৃত্যুতে পুরো জেলার মানুষ যেন শোকাহত হয়ে পড়েছেন।ছোট ভাই রুবেল জানান, দরিদ্র পরিবার হওয়ায় পরিবারের সব কিছুই সোহেল দেখাশোনা করতেন। তাদের তিন ভাইয়ের সম্পর্ক
ছিল বন্ধুর মতো। চাকরির ছুটিতে ভাই বেড়াতে এলে একই বিছানায় তারা ঘুমাতেন। এমন অনেক স্মৃতির কথা বললেন ছোট ভাই রুবেল ও উজ্জ্বল।মাত্র তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি নেন সোহেল। অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। দরিদ্র পরিবারটির একমাত্র উপার্জনশীল ছিলেন সোহেল। একটি টিনের দোচালা ঘরে বাবা-মা,
চাচা-চাচীসহ সবাই থাকেন গাদাগাদি করে। বাবা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইজড। বাড়ির পাশের চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না সোহেল রানার। অটোরিকশা চালিয়ে আর প্রাইভেট পড়িয়ে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ২০১৪
সালে।পরের বছরই যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে। তার আয়েই চলত পরিবারের ভরণপোষণ ছাড়াও ছোট ভাইদের লেখাপড়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপদে পড়েছে পরিবারটি।