
ছাতক প্রতিনিধি:
পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার যুবক শিপন অসচ্ছল পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে ভাগ্য বদলাতে সমুদ্রপথে ইতালি যেতে চেয়ে দালালের খপ্পরে পরে সর্বস্ব হারিয়েছেন ছাতকের যুবক শিপন। তিউনেশিয়া থেকে উদ্ধার হওয়া ১৭ বাংলাদেশীর মধ্যে একজন শিপন। সোমবার(২৪জুন) দুপুরে মা বাবার কাছে ফিরেছেন এই যুবক।সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরগাতি গ্রামের যুবক শিপন আহমেদ এলাকায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাতেন। তার পরিচিত এক যুবক লুৎফুর রহমান নামে শিপনকে সমুদ্রপথে ইতালি পৌছে দেবে বলে কথা দিয়েছিলো। কিন্তু শিপনকে আটকে রেখে পরিবারের কাছ থেকে লুৎফুর রহমানসহ দালালরা কৌশলে আদায় করে নেয়
১০লাখ টাকা। লুৎফুরের পিতা জমির আলী শিপনের পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় এই টাকা নেয়। উত্তাল সমুদ্রে ৩ সপ্তাহেরও বেশি সময় ভাসতে থেকে মৃত্যুর মুখ থেকে তিউনেশিয়া হয়ে বেঁচে ফিরেছেন শিপন। এই সময়ে দালালদের পক্ষ থেকেও কোন তৎপরতা না থাকায় পরিবারের কাছে নিখোঁজ ছিলেন শিপন।শিপনের কোন খবর না পাওয়ায় দুঃশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় ছিলেন শিপনের মা -বাবা। সোমবার(২৪জুন) দুপুরে শিপন ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরগাতি গ্রামে তার নিজ বাসায় ফিরে আসলে মা মিনারা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তাকে দেখতে বাড়িতে জড়ো হন এলাকার বাসিন্দারা। এসময় সাংবাদিকদের কে এই ভ্রমনের বিষয়ে বলেন শিপন।শিপন আহমেদ বলেন‘ তিউনেশিয়া থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করা
হয় এই শর্তে যে আমরা বাড়িতে ফিরে আসবো, আমরা সবাই বাড়িতে ফিরতেই অপেক্ষায় ছিলাম, বিদেশে যাওয়ার সব শখ গত ৩ সপ্তাহেই মিটে গেছে আমাদের, অবস্থা এমন ছিলো যে বাঁচার জন্য অনেকে নিজের প্রস্রাব নিজেই খেয়েছি গত কয়েক দিন। আর এক দিন থাকলে আমরা হয়তো মরেই যেতাম, আমি আমাদের দূতাবাস কে ও সেখানকার আইন শৃংখ্যলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই, আল্লাহর পরম করুণায় তারা আমাদের বাঁচতে সহযোগিতা করেছেন’।শিপন বলেন ‘ আমি কম লেখাপড়া করেছি, তাই এলাকায় সিএনজি চালাতাম, আমার পরিচিত একজন লুৎফুর রহমান লিবিয়া গিয়েছে, সে প্রায়ই আমাকে ফোনে বলতো বিদেশ নিবে, আমি যাতে টাকা পয়সা রেডি করি সেজন্য তাগিদ দিতো, অভাবের সংসার টা বদলাতে চাইসিলাম, আমাদের অসচ্ছলতা
আর থাকবেনা ভেবেছিলাম, লোকে না জানলেও কষ্ট করেই চলতাম আমি, তাই এইটাকে একটা সুযোগ মনে করেছি, কিন্তু জমি বন্ধক রেখে, গরু-বাছুর বিক্রী করে মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা এনে এমনটা হবে সেটা কোনদিন চিন্তাও করিনি’।শিপন আরও বলেন ‘ লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে আটকে রেখে টাকা নেয়া হয়েছে, মারধর তো করতোই, লিবিয়া থেকে ইতালি নিবে বলে আরও ৩ লাখ টাকা নিয়েছে আমার বাড়িতে ফোন করে, আমার কাছ থেকে সব মিলিয়ে লুৎফুর ও তার বাবা জমির মিলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে, কিন্তু ক্ষতিপুরণ তো চাইতে পারবো না, জমির আলী দালাল হলেও এই এলাকায় তার অনেক প্রভাব, এর জন্য হয়তো কোনদিন ওদের বিচারও হবেনা, পুলিশের কাছেও যেতে ভয় হচ্ছে, কারণ দালালের লোকজন রাস্তায় আমাকে মেরে
ফেলবে’।সাংবাদিকদের কে শিপন বলেন ‘ আমাকে বড় জাহাজে করে পাঠানোর কথা ছিলো, সে শর্তে টাকা দিয়েছিলাম, কিন্তু আমার মতো আরও ৭৩জনকে নিয়ে সাগরের পাড়ে একটা ছোট নৌকায় উঠিয়ে দিলো দালালরা, এটা এতোই ছোট ছিলো যে তাদের প্ল্যান ছিলো আমরা যেনো সাগরের মাঝখানে ডুবে যাই, কিন্তু আল্লাহ বাঁচাইসেন, প্রত্যেকটা দিন মানুষ চিৎকার করে কাঁদতো, কিন্তু এই কান্না শোনার মতো কেউ ছিলো না, ২সপ্তাহ আমরা কিছু খাইনি, চিন্তা করতাম আর কোনদিন হয়তো মায়ের কাছে আসতে পারবো না, বড় ভুল করেছি সেটাও ভাবতাম, কিন্তু আল্লাহর কাছেই বিচার চাইতাম, আল্লাহ যেনো এই দালালদের বিচার করেন’।সম্পদের সব হারিয়ে গেলেও নিজেদের ছেলে ফিরে আসায় হৃদয় খুশিতে ভরে উঠেছে বাবা হেলাল মিয়া ও মা মিনারা বেগমের।
তবে তারা সরকারের কাছে এই দালাল চক্রের দৃষ্টান্তমুলক বিচার দাবি করেন ।শিপনের মা মিনারা বেগম বলেন ‘ আমার সব বিক্রি কইরা জমি বন্ধক দিয়া ছেলেরে বিদেশে পাঠাইতাম চাইসি, কিন্তু দালালরা আমার ছেলেরে মারার চেষ্টা করসে, এতো টাকা নিয়া গেছে, আমারে ঠকাইসে, আমি এর বিচার চাই’।বাবা হেলাল মিয়া বলেন ‘ গত মার্চ মাসে শিপন কে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে টাকা নেয় মায়ের কোল গ্রামের দালাল লুৎফুর রহমান ও তার পিতা জমির আলী। পরে শিপন কে লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে তার কাছ থেকে ২লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। পরে ইতালি নেয়ার কথা বলে গত ২১ মে আরও ৩লাখ টাকা চেয়ে নেয় লুৎফুরের পিতা জমির আলী। টাকা নেয়ার পর লুৎফুর আমাদের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, ছেলের কোন খোঁজ পাইনি, পরে
টিভিতে খবরে জানলাম আমার ছেলে উদ্ধার হইসে, এই ঘটনায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই।শিপন অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসায় খুশি তার ভাই শোয়েব আহমেদ রিপন। তিনি বলেন‘ আমার ভাই যে আমাদের মাঝে এসেছে সেজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি, আমার মা বাবা রোজ কান্না কাটি করতেন, মা রাতে ঘুমাননি কতোদিন, ভাইয়ের চিন্তায় অসুস্থ্য হয়ে গেছেন’।প্রতারিত ও অত্যাচারের শিকার হওয়া যুবক শিপন আহমেদ আর কোন বাংলাদেশীকে সমুদ্রপথে বিদেশ না যেতে আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন ‘ আমি সারাদিন যদি কথা বলি তবুও
বুঝাতে পারবোনা যে আমি কতো বড় বিপদে ছিলাম, এমন অবস্থা আল্লাহ আর যেনো কাউকে না দেখান, যারা বিদেশ যেতে চান তাদের কাছে আমি করজোড়ে অনুরোধ করি, তারা যেনো মায়ের কাছে থাকেন, নিজের পরিবারের সাথে অভাব অনটনেও কষ্ট করে থাকা অনেক সুখের, কখনোই নিজের পরিচিত কারো মাধ্যমে যেনো নৌ পথে কোন দেশে যেতে রাজী না হন’।শিপন তার পরিবারে ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। বাকি ৩ভাই এলাকাতেই থাকেন। এই মুহুর্তে তার পরিবার প্রকটভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হন।