
ছাতক প্রতিনিধি:
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-এ দাবীতে ১৯৫২ সালে সারা দেশের ন্যায় ছাতকের ছাত্র ও যুব সমাজকে সাথে নিয়ে যারা রাজপথ কাপিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে মাষ্টার ইমতিয়াজ আলী অন্যতম। তৎকালীন সময়ে মাতৃভাষা বাংলা’র দাবী নিয়ে এলাকার যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইমতিয়াজ আলীসহ অত্র অঞ্চলের আরো কয়েকজন সাহসী নেতা। পুলিশি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইমতিয়াজ আলীরা রাজপথে থেকে মিছিল-মিটিং করেছিলেন মাতৃভাষার দাবীতে। ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের যে অবদান রয়েছে তা আজ
অনেকেরই অজানা। ইতিহাসের পাতায় এসব ভাষা সৈনিকের অবদান স্থান পেয়ছে কি না তা জানা না থাকলেও অবহেলিত ভাষা সৈনিক ইমতিয়াজ আলীদের তালিকা করে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাদের অবদানকে সম্মান জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পাশপাশি ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলে বীর সৈনিকদের অবদান ও প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্বও নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই- এ শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ছালাম, রখত, জব্বারসহ নাম
নাজানা বহু ছাত্র-জনতা আত্মাহুতি দিয়েছিল মাতৃভাষার জন্য। ভাষার দাবী নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছাত্র ও যুবসমাজ রাজপথে আন্দোলন করেছে। পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেয়া উর্দ্দু ভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল গ্রাম-বাংলার দামাল ছেলেরা। এসব প্রতিবাদী ও সাহসী যুবকদের মধ্যে ছাতকের ইমতিয়াজ আলী ছিলেন অন্যতম। ছাতক উপজেলার সদর ইউনিয়নের আন্ধারীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ইমতিয়াজ আলী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন বীর সেনানী। ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের
অংশগ্রহন ও অবদানের বিষয় নিয়ে মাষ্টার ইমতিয়াজ আলীর সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১৯৫২ সাল, তখন তিনি ৭ম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন। ৭ম শ্রেনীর ছাত্র হলেও শারীরীকভাবে তিনি ছিলেন লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। দেখতে অনেকটা ১৬-১৭ বছরের যুবকের মতো মনে হতো। রাজনীতি ততটা না বুঝলেও মাতৃভাষার প্রতি বুকভরা শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা ছিল এ ভাষা সৈনিকের। পাকিস্তানী শাসকের ঘোষনা মতে উর্দ্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা-এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ইমতিয়াজ আলী। প্রতিবাদী হয়ে সহপাঠীদের সংঘবদ্ধ করে মাতৃ ভাষার
আন্দোলনে নেমে পড়লেন রাজপথে। বহু বাধা-বিপপ্তি উপেক্ষা করে ছাতকে ভাষা আন্দোলন চাঙ্গা করেছিলেন তারা। ছাতক হাই স্কুল ও কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে তারা গোপন মিটিং করতেন কুমনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। ইমতিয়াজ আলীর সাথে এখানের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সদর ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা ডাঃ গোলাম মন্তকা, কালারুকা ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের জোয়াহির মিয়া, দিগলবন্দ গ্রামেরর কাপ্তান মিয়া, আব্দুল খালিকসহ আরো অনেকেই। এসব ভাষা সৈনিকদের মধ্যে শুধু মাষ্টার ইমতিয়াজ আলী ও ডাঃ
গোলাম মন্তকাই জীবিত আছেন। তারাও বয়সের ভারে এখন ন্যুজু হয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ায় কথা মনে হলে আজো আবেগ আপ্লোত হয়ে উঠেন মাষ্টার ইমতিয়াজ আলী। মল্লীকপুর প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ছাতক বহুমুখী হাইস্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন কমপ্লেইট করেন ১৯৫৬ সালে। পরে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে প্রথম বিভাগে আইএ এবং ১৯৭৪ সালে প্রাইভেটভাবে পরীক্ষা দিয়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে ইমতিয়াজ আলী শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়ে ছিলেন। ভাটরাই যুরিয়র হাইস্কুলে শিক্ষকতা
দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন কর্মজীবন। তিনি ১৯৬৩ সালে নতুন বাজার জুনিয়র হাইস্কুলে, ১৯৯৮ চেচান সিডিপি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ২০০৬ সালে এলঙ্গি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কালের বিবর্তনে এসব মহান ব্যক্তিত্ব ভাষা সৈনিকদের কথা কেই বা স্মরন রাখে। ছাতক সদর ইউনিয়নের আন্ধারীগাঁও গ্রামের নিজ বাড়িতে এখন জীবনাবসানের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ভাষা সৈনিক শিক্ষক ইমতিয়াজ আলী।১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন এদেশের নিরস্ত্র কৃষক, শ্রমিক ছাত্র-জনতা সশস্ত্র
পাকহানাদার বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। ছিনিয়ে এনেছিল একটি লাল-সবুজের পতাকা ও বাংলাদেশ নামক একটি নির্দিষ্ট ভু-খন্ড। আর তাদের মাধ্যমেই বাংঙ্গালী জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সরকারীভাবে দেশের এসব সূর্য্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে। তেমনিভাবে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছে, আত্মাহুতি দিয়েছে সরকারীভাবে তাদেরও দেয়া হয়েছে স্বীকৃতি। কিন্তু তৃণমুল পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের এমন বহু বীর সেনানী রয়েছেন যাদের নাম,
অবদান থেকে গেছে অন্ধকারে। এক সময় এসব ভাষা সৈনিকদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস তলিয়ে যাবে অথৈ গহীনে। এমনই ক’জন ছাতকের ভাষা সৈনিক মাষ্টার ইমতিয়াজ আলী, ডাঃ গোলাম মন্তকা, জোয়াহির মিয়া, কাপ্তান মিয়া, আব্দুল খালিকরা রয়ে গেছেন প্রচার বিমূখ। অনেকেই চলে গেছেন পরপারে। আর যারা জীবিত আছেন, অনাদরে অবহেলায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ইতিহাসে হয়তো বা এসব মহান ব্যক্তিদের নাম লিপি বদ্ধ হবে না। রচিত হবে না ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের বীর সৈনিকদের অবদানের কথা। তবে ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের
মানুষেরও যে অবদান ছিল তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদেরই কর্তব্য। অন্যতায় ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষের অবদান কেউ কখনো হয়তো জানতেও পারবে না। জীবিত ভাষা সৈনিকদের খুঁেজ বের করে তাদের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলনে এ অঞ্চলের অবদান ও সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা খুবই প্রয়োজন। নতুবা ইতিহাস আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না।