
ছাতক প্রতিনিধি:
ছাতকে নৌ-পথে চাঁদাবাজি থামছেনা ভৌগলিক অবস্থানগত সমস্যা ॥ স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিকবর্গের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে অভিযোগ ॥ থামছেনা চাঁদাবাজি ॥ পুলিশের অভিযান অব্যাহত ॥ নামছে র্যাব গত ১৪মে রাত্রে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার পৌর শহরে সুরমা নদীতে চাঁদাবাজি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আ.লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাহাব নামে এক ব্যাক্তি। ওই সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় ব্যবাসায়ীসহ প্রায় চারশতাধিক ব্যাক্তিকে আসামি করে পৃথক তিনটি মামলাও
করা হয়। চাঁদাবাজি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার পর গত দু’মাস গা-ঢাকা দিয়ে থাকার পর ছাতক-কোম্পানীগঞ্জ নৌ-পথের চাঁদাবাজরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জানা যায়, প্রতিদিন এ নৌ-পথের ৫-৬টি স্থানে পাথর-বালু, চুনাপাথরবাহী বার্জ-কার্গো ও নৌকা থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চাঁদাবাজরা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কতৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ ইঞ্জিন এন্ড বাল্কহেড বোট ওনার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাতক পৌরসভা, যুব সমাজ কল্যান সংস্থা, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীতে পাথর আহরনকারী নৌকা
হতে টেক্স আদায় মহাল (উপজেলা টেক্স) এবং বিভিন্ন নদীপথে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ও পাথরবাহী ইঞ্জিন চালিত ও ইঞ্জিনবিহীন কেজা/বৈঠা) নৌযান হতে ১৪২৬ বাংলা সনের উপজেলা ট্রাক্স আদায় রশিদ, উপজেলা বাস-কার্গো মহাল (উপজেলা টেক্স) কোম্পানিগঞ্জসহ বিভিন্ন নামে ৪শত টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ব্যাক্তি নিহত হওয়ার পর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেয়। কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগও করা হয়। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীতে স্থানীয়
সংসদ সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পৃথক ভাবে বৈঠকও করেন। বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন চাঁদাবাজকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। সম্প্রতি আবারও একাধিক স্থানে চাঁদাবাজির কারনে চরম হতাশায় ভোগছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। তারা এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সুরমা, চেলা এবং পিয়াইনে নৌ-পথে বালু, পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা নিতে আসে বাল্কহেড, বার্জ, কার্গো ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌ-পরিবহন। এ ধরনের যান চলাচল বর্ষা মৌসুমে অনেকটা বেড়ে যায়। এসব নৌ-পরিবহন
ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভাছড়া পাথর কোয়ারিসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে পাথর সংগ্রহ করে। এ ছাড়াও ভারত থেকে চুনাপাথর, বোল্ডার-সিঙ্গেল আমদানি করেও ছাতক নৌ-বন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাম্পিং করা হয়। এসব স্থানের ব্যাবসায়ীদের নৌ-পরিবহনকে ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী নৌপথের ইছাকলস, চেলা নদীর মুখ, থানাঘাট, চাঁদনীঘাট, পেপারমিল ঘাট, নোয়ারাইঘাট, বারকাপন ও বাউসা এলাকায় চাঁদা দিতে হয়। যাদের চাঁদা আদায়ের বৈধতা রয়েছে তারাও টোল আদায়ের নামে অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করছেন অভিযোগ উঠেছে। এ
কারনে ছোট-বড় শতাধিক নৌ-পরিবহনকে ঘাটে ঘাটে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ছয় হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে।আরো জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছাতক নদীবন্দর এলাকা ঘোষণা করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ এর পর থেকে ইজারা শুরু করে। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট থেকে দুই কোটি দুই হাজার টাকায় ইজারা নেয় মেসার্স কালা মিয়া। নৌ-পরিবহনের আকার ও ধরন অনুযায়ী ২শত থেকে ৫শথ টাকা করে টোল আদায়ের কথা থাকলেও প্রতিষ্টানটি দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা আদায় করছে। ছাতক পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রতিটি নৌযানকে নদীর ঘাট ব্যবহারে ৩৫০ টাকা ও
পৌরসভার ট্যাক্স হিসেবে ৪০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ট্যাক্স আদায়কারীরা আদায় করছেন পাঁচশ’ থেকে এক হাজার টাকা।এ বিষয়ে এম বি কোয়াজ কিজির নৌ-পরিবহনের মালিক পরিচয় দিয়ে ইয়াছিন মিয়া বলেন, আজ (মঙ্গলবার) ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাতক উপজেলার ইসলামপুর (জামুরাইল) ঘাট থেকে লোড নিয়েছি। এরিই মধ্যে ছাতক পৌরসভার দু’টি টেক্স ৪শত টাকা ও ৫শত টাকা, যুব সমাজ কল্যান সংস্থা ইসলামপুর ২শত টাকা, বার্জ ও কার্গো মহাল উপজেলা কোম্পানিগঞ্জ ১ হাজার ৫শত টাকা, বিআইডাব্লিউটিএ ৪ হাজার টাকাসহ মোট ৬ হাজার ৬শত টাকা টোল দিয়েছি।
এম বি আল্লাহর দান নৌ-পরিবহনের মালিক পরিচয় দিয়ে খলিল মিয়া বলেন, গত শুক্রবার ছাতক উপজেলার ইসলামপুর (জামুরাইল) ঘাট থেকে চাঁদপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে লোড করি। লোড নিয়েই ১ হাজার ৫শত টাকা, তার পর আরেকটি ১ হাজার টাকা, পৌরসভার দুটি ৫শত ও ৪শত টাকা, বার্জ ও কার্গো মহাল ছাতক ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নামে পৃথক দুটি ১ হাজার ৫শত টাকা, রইছ বডিং এর সামনে এসে ৫শত টাকা কিছু দুর যেতে আরেকটি ১ হাজার ৫শত টাকা দাবি করে। লাটি হাতে আমাদের ধমক দেয়। এসময় তিনি বলেন ধমক দিবেন না। আমাদের লোক আছে, বডি আটকামু। পরে
তারা চাঁদা না নিয়েই তারা পালিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, চাঁদার রশিদ আমার সাথে নেই। তাই নাম বলতে পারছিনা। পরে ফোনে আপনাকে নাম বলছি।এম বি মা বাবার দোয়া নৌ-পরিবহনের মালিক পরিচয় দিয়ে কাইয়ুম মিয়া বলেন, অসহনীয় চাঁদাবাজী চলছে। চাঁদা না দিলে মার-পিট করতে চায়। ৩ হাজার ৫ শত টাকা, ১ হাজার ৫শত টাকা, ১ হাজার টাকা, ৪শত টাকা, ৫শত টাকা ও অপর একটি ১ হাজার টাকা চায়। ৭ শত টাকা দিলে ১ হাজার টাকার রশিদ দেয়। আবার কোন কোন সময় কম দিলে মানছেনা।ছাতক পৌর সভার মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী পৌরসভার অতিরিক্ত
টোল আদায়ের কথা অস্বীকার করে বলেন, পৌরসভার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায় করা হচ্ছে। আমারা এ বিষয়টি সার্বক্ষনিক মনিটরিংও করছি। অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধে আমাদের সদিচ্ছার কোন অভাব নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধে বিভিন্ন সময় আমরা চাপ সৃষ্টি করেছি। কিন্ত একটি সমস্যা হলো ছাতক থানার সামন থেকে (টুক) ওই অংশটি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা। দুই উপজেলার ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে একটি সমস্যা রয়েছে।ছাতক নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, নৌ-পথে চাঁদাবাজী বন্ধে আমাদের অভিযান
অব্যাহত রয়েছে। আজ (মঙ্গলবার) সারাদিন আমি অভিযান পরিচালনা করি। এ সময় বেশ কিছু চাঁদাবাজকে ধরার চেষ্টা করি। কিন্ত আমাদেও দুর থেকে দেখে তারা পালিয়ে যায়। চাঁদাবাজি বন্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।ছাতক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তাপশ শীল বলেন, সুনামগঞ্জের ছাতক ও সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা এখানে ভৌগলিক একটি বিষয় রয়েছে। দুই উপজেলা মিলে সমন্নিত উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা চলছে। জেলায় বিষটি নিয়ে আলোচনা করেছি। চাঁদাবাজি বন্ধে র্যাব এর অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি।
বিআইডাব্লিউটিএ এর আশুগঞ্জ ভৈরববাজার নদীবন্দর পোর্ট অফিসার আসাদুজ্জামান বলেন, ২০০ থেকে ৫০০ টাকার এ হিসাবটি সঠিক না। বিষয়টি হচ্ছে প্রতি ঘন মিটার আর ঘনফুটের হিসাব। প্রতি ঘন মিটার হলো পঁচিশ পয়সা করে আর প্রতি ঘন ফুট হচ্ছে আট টাকা বিরান্নব্বই পয়সা করে। এটা বাল্কহেডের আকারের উপর নির্ভর করে। যে বডিতে যে পরিমান মাল ধরবে এই অনুপাতে টোল আদায় করবে। কোথাও কোথাও অভিযোগ পাই আড়াই হাজার টাকা আসছে দুই হাজার টাকা দিয়েছে আবার তিন হাজার টাকা আসছে সাড়ে তিন হাজার টাকা অথ্যাৎ পাঁচ শত টাকা অতিরিক্ত নিয়েছে।
আমরা যখন এ সব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাই তখন তাদের সকজ করি। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সুনামগঞ্জে এই সমস্যা রয়েছে প্রায়ই শুনা যায়। অবৈধ ভাবে যদি কেউ চাঁদাবাজি করে আমরা চাই তারা আইনের আওতায় আসুক। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হোক এটা আমি মনে প্রাণে চাই। এ ক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে কোন ঘাটতি রাখিনি। পুলিশ বার বার অভিযান পরিচালনা করছে। আমার নাম্বারও দেওয়া আছে। তাৎক্ষনিক ভাবে আমার সাথে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে। একটি সমস্যা হলো স্থানীয় কিছু লোকজন হয়তোবা জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিকবর্গ আমাদের প্রয়োজনীয় সহযোগীতা করছেন না। পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।