আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
সরকারি হিসাবে’ বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাসে মিয়ানমারে মৃত্যু হয়েছে এ পর্যন্ত মাত্র ৫ জনের। আর দেশটির আরাকান ও চিন প্রদেশে প্রতিদিনই যুদ্ধে মরছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নাগরিক। সারা বিশ্ব এখন মহামারী করোনা ভাইরাসের যুদ্ধে ব্যস্ত। তাই কামান-বন্দুকের যুদ্ধে মনোযোগ নেই প্রচারমাধ্যমের। ঠিক এই ফাঁকেই জ্বলেপুড়ে ছারখার করা হচ্ছে উত্তর আরাকান ও পাশের চিন। যুদ্ধাঞ্চলটি বাংলাদেশের কক্সবাজার-বান্দরবান সংলগ্ন। বাংলাদেশের পক্ষে এই যুদ্ধে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই ।
উত্তর আরাকানের মংডু, বুথিডং, রাথিংডং এলাকা কক্সবাজারের কাছেই। এর সঙ্গে লাগোয়া চিন প্রদেশের পালেটাওয়ায় মূল যুদ্ধ চলছে এখন। একদিকে রাখাইন তরুণদের আরাকান আর্মি (‘এএ’), অন্যদিকে ‘টাটমাড্’ নামের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। পালেটাওয়া বান্দরবানের কাছাকাছি শহর। এর সঙ্গে মিজোরামেরও সীমান্ত রয়েছে। মূল যুদ্ধ পালেটাওয়ায় চললেও বুথিডং, কাইয়ুকতাও, মারাক-উসহ উত্তর-পূর্ব আরাকানের সকল গ্রামগঞ্জ এই মুহূর্তে যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে।
২০১৯-এ যুদ্ধ শুরু হলেও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের আড়ালে এএ ও টাটমাড্ সর্বশক্তি নিয়ে এখন যুদ্ধে শামিল হয়েছে। স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি টাটমাড্ বিমানবাহিনীও মোতায়েন করা করেছে সেখানে। তবে আরাকান আর্মির প্রবল প্রতিরোধ, উন্নত যুদ্ধ-ক্ষমতা ও কৌশলে তারা কিছুটা হতচকিত। রাখাইন গেরিলারা মূলত দুটি ফ্রন্টে হামলা চালাচ্ছে। টাটমাড্’র পাশাপাশি বামারদের সহযোগী স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে তারা। ফলে স্থানীয় প্রশাসন বলে এখন আর কিছু কাজ করছে না। প্রধান সড়কগুলোতে ল্যান্ডমাইনের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপন্ন।
সেখানে বিপুল রাখাইন উদ্বাস্তু হচ্ছে যুদ্ধের মূল কারণ রাখাইনদের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা। এ এই অঞ্চলে বার্মার আধিপত্যের অবসান চাইছেন। তবে যুদ্ধ তীব্র রূপ নেওয়ার তাৎক্ষণিক কারণ অন্যত্র। এএ আরাকানে বড় পরিসরে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি গড়তে চাইছে। মিয়ানমারের অনেক প্রদেশেই স্থানীয় জনজাতিগুলোর নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ও সেনাসদর রয়েছে। কাচিনে আছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি; শানে রয়েছে ওয়া আর্মি। রাখাইন গেরিলারাও আরাকানে একটা ঘাঁটি এলাকা করতে চাইছে এখন।
২ বছর থেকে তারা কাচিন থেকে চিন হয়ে আরাকানে ঢুকছে। পালেটাওয়া ভৌগোলিকভাবে তাদের খুব দরকার। সে জন্যই যুদ্ধটা এখানে কেন্দ্রীভূত। এএ’র গেরিলারা ইতিমধ্যে পুরো আরকান জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। রাখাইনেরা তাদের নীরবে সমর্থন দিচ্ছে। আরাকানের প্রধান রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টির কর্মীরাও এএ’র প্রতি সহানুভূতিশীল। রাখাইন জাতীয়তাবাদের স্থানীয় এই সমর্থন এএকে টাটমাড্’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এগিয়ে রাখছে। এসবের মাধ্যমে তারা উত্তর আরাকান ও দক্ষিণ চিন সীমান্তে একটা ‘সদর দপ্তর’ কায়েম করতে মরিয়া এখন। তাদের লক্ষ্য মারাক-উ এলাকা। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৫ পর্যন্ত যা আরাকানিজদের স্বাধীন রাজধানী ছিল। চলতি যুদ্ধের তাৎক্ষণিক বড় কারণ এটাই।
তবে টাটমাড্ এএকে গ্যারিসনধর্মী কিছু গড়তে দিতে অনিচ্ছুক। তারা পোড়ামাটি নীতিতে সশস্ত্র রাখাইনদের আকাঙ্ক্ষায় বাধ সেধেছে। ফলে বিপুল রাখাইন উদ্বাস্তু ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই যুদ্ধের আলোচনায় নাটকীয়ভাবে চলে এসেছে গণচীন ও ভারতের স্বার্থের কথাও। ভারতের প্রচারমাধ্যম সম্প্রতি এই যুদ্ধে চীনের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ছেপেছে। শি জিনপিং জানুয়ারিতে মিয়ানমার আসার পর থেকে ভারতে প্রচারমাধ্যম আরকানে চীনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যায়। আরাকান আর্মি’র অভিভাবক নিয়ে রহস্য
এক দশক আগেও এএ মাত্র কয়েক ডজন তরুণের একটা সামরিক গ্রুপ ছিল। কাচিনের লাইজায় তারা প্রথম প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে।
বর্তমানে এই বাহিনীতে রয়েছে প্রায় আট হাজার যোদ্ধা। শান স্টেইটের ওয়া আর্মি এবং কাচিনদের বাহিনীর বাইরে এএ’ই এখন টাটমাড্’র জন্য বড় মাথাব্যথা। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো, এএ প্রধান যে দুটি গেরিলা দলের সাহায্য সহযোগিতা পায় (কাচিন আর্মি এবং ওয়া আর্মি) উভয়ে চীন সীমান্তবর্তী এবং চীনের সাহায্যপুষ্ট। মিয়ানমারে ওয়া আর্মিকে চীনের ‘প্রক্সি’ বিবেচনা করা হয়। আর এএ হলো ওয়া আর্মির প্রক্সি। কিন্তু এএ’র ‘আরাকান অফেনসিভ’-এ চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থও ক্ষতির মুখে পড়েছে।
টাটমাড্ এবং মিয়ানমার সরকারের প্রধান আন্তর্জাতিক বন্ধু চীন। ফলে পর্যবেক্ষকেরা ধাঁধাঁয় পড়েছেন। এএ ভূ-রাজনীতিতে কার স্বার্থে কাজ করছে সেটা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। এও বোঝা যাচ্ছে না কেন চীন বা ওয়া আর্মি এএকে থামানোর চেষ্টা করছে না। এমন প্রশ্নও উঠেছে চীন টাটমাড্ এবং এএ উভয়কে মদদ দিয়ে যাচ্ছে কি না? আরকানে চীনের অর্থনৈতিক প্রকল্প বহু। গভীর সমুদ্রবন্দর করছে তারা। সঙ্গে রয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। দুটো প্রকল্পই মিয়ানমার-চীন অর্থনৈতিক করিডরের অপরিহার্য অংশ। এই অর্থনৈতিক করিডর ও আরাকানের ভেতর দিয়ে চীন ভারত মহাসাগরের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ করে নিতে চলেছে। সমুদ্র-রাজনীতিতে এটা হবে চীনের এক বড় অর্জন।
চীনের এই অর্জনের সঙ্গে সমান তালে ভারতেরও বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে আরাকানে। যার মধ্যে একটি হলো বহুল আলোচিত ‘কালাধন মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট প্রকল্প’। কলকাতা থেকে সমুদ্র পথে বাংলাদেশের পাশ দিয়ে আকিয়াব হয়ে মিজোরাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে যুদ্ধবিধ্বস্ত পালেটাওয়াকেও যুক্ত করার কথা। পালেটাওয়া থেকে মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত ১০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি হবে। প্রকল্পের এই অংশটুকু এখন যুদ্ধের কারণে আটকে গেছে। চিন প্রদেশে এএ’র তৎপরতায় ভারতও তাই চীনের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে তারা এই যুদ্ধে বেইজিংয়ের অবস্থান নিয়ে সন্দিগ্ধ।
যে কারণে আরাকানে নানানভাবে তারাও উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কয়েকশ ঘর বানানোর একটা প্রকল্প শেষ করেছে তারা সেখানে। আকিয়াবের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কম্পিউটার ল্যাব গড়া হচ্ছে। আরাকানে ধান ও মসুরের ডালের উৎপাদন বাড়াতে টাক্ট্রর ও হার্ভেস্টার দেওয়ার আরেকটি কর্মসূচিতেও সহায়তা দিচ্ছে ভারত। গত বছর ভারত ও টাটমাড্ ‘অপারেশন সানসাইন’ নামে একটা সামরিক অভিযানও পরিচালনা করে সীমান্তে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার পর দুনিয়াজুড়ে মিয়ানমারকে বয়কটের মুখেই আরাকানে চীন-ভারতের এসব ‘বিনিয়োগ’ চলছে। আরাকানকে ভারত মনে করছে ‘লুক-ইস্ট’ নীতির স্তম্ভ। আর চীন মনে করছে ভারত মহাসাগরে পৌঁছানোর অনিবার্য পথ। কিন্তু এএ মনে করে, বিভিন্ন দেশ সকল কাজই করছে স্থানীয়দের সিদ্ধান্ত ছাড়া। রাখাইন তরুণদের এখানেই আপত্তি। এএ তাই চীনের প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের বিকল্প খুঁজে নিতে পেরেছে বলে অনুমান করা হয়।
বাংলাদেশের জন্য খারাপ বার্তা চিন-আরাকানের যুদ্ধাবস্থা এবং সেখানে শক্তিধর দেশগুলোর প্রতিযোগিতামূলক উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নতুন করে একটা খারাপ বার্তা। এই যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ের বিষয় আন্তর্জাতিক মনোযোগে আনা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম বন্দর লাগায়ো এই অঞ্চলে এএ’র সামরিক অগ্রগতি যেমন গভীর তাৎপর্যবহ তেমনি টাটমাড্’র জ্বালাওপোড়াও কৌশলও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের। সারা পৃথিবী যখন করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই মিয়ানমার যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।