
গ্রামের নাম বাঘাইছড়ি। এটি একটি ছোট গ্রাম। গ্রামে নানারকম মানুষের বাস। গ্রামে সবার থেকে আলাদা একটা পরিবার আছে। যা সবার কাছে উচুঁ
পরিবার নামে পরিচিত। এই পরিবার কে সবাই ভয় পাই। এই ভয় পাওয়া কে ঐ পরিবার সম্মান মনে করেন। তারা বলে সবাই তাদের কথা মতো চলে, তাদের ভয় করে আর এই ভয় পাওয়া মানে তোমরা আমাদের সম্মান করো। আমরা এই গ্রামের একমাত্র সম্মানিত পরিবার।
ঐ গ্রামে একটি ব্যবসা আছে, আর কোনো ব্যবসা বাণিজ্য নাই। থাকবে কি করে কাউকেতো ব্যবসা করতে দেয়না ঐ সম্মানিত পরিবার। কারণ অন্য কেউ ব্যবসা করলে তাদের সাথে মিলে যাবে। তখন গ্রামে আরেকটা সম্মানিত পরিবার চলে আসবে, এটাতো গ্রামের সম্মানিত পরিবারের কর্তা আজগর খাঁ কখনো হতে দিবেননা। তিনি চান শুধু আজীবন তিনি একমাত্র সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে থাকবেন বাঘাইছড়ি গ্রামে।
আজগর খাঁ বিশিষ্ট শুটকি ব্যবসায়ী। গ্রামে আছে তার শুটকির বড় আড়ত। গ্রামে ছোট থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত ঐ আড়তের চাকুরীজীবী। আর আজগর খাঁ হলেন এই আড়তের মালিক। আজগর খাঁ এর স্ত্রী মারা গেছে সে অনেক বছর আগে। পুত্র সন্তান একটি আছে সে থাকে বিদেশে। আজগর খাঁ আড়তে আসে বিকেল পাঁচটায়। তার জন্য তো শুভ সকাল হয় বিকাল পাঁচটায়। তিনি আড়তে আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের চাকুরীজীবী সবাইকে দাড়িয়ে বলতে হয় শুভ সকাল মালিক। এইটা হল আজগর খাঁ এর করা নিয়ম। তিনি একটু বেশী ঘুমান, একটু বললে ভুল হবে বরং বলি দীর্ঘক্ষণ ঘুমান। বিকাল পাঁচটায় হয় তার জন্য সকাল তাই সবার জন্য বিকাল বেলায় আরেক নতুন সকালের জন্ম দিলেন আজগর খাঁ। না হয় সে বুঝাবে কেমনে সে গ্রামে অন্যদের চেয়ে আলাদা সে সম্মানিত ব্যক্তি। তার মতে সম্মানিত ব্যক্তিদের একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠতে হয়।
প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা হলে আড়তে আসেন আজগর খাঁ, হিসাব নেন সবার থেকে এবং টাকা পয়সা নিয়ে চলে যান। বাসায় গিয়ে একটু আহার করে আবার বিছানায় লুটিয়ে পরেন পরেরদিন বিকেল পাঁচটার জন্য।
এতক্ষণ শুনেছেন আজগর খাঁ এর একটি নিয়ম এবার শুনুন আরেকটি, গ্রামের কেউ আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। তারা শুধু বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিবে তার আড়তে। শুধু বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে যাবে তার জন্য। গ্রামের সবাই খাবার খাই আড়তে, আর গ্রামের মহিলারা আড়তের সবার জন্য রান্নাবান্না করে।
আজগর খাঁ এর মতে গ্রামের পুরুষরা শুধু কাজ করবে আড়তে আর গ্রামের মহিলারা তাদের জন্য খাবার রান্না করবে। এটাই হবে নিয়ম, এই নিয়মে সবাইকে চলতে হবে। সবাই চুপ থাকে আর নিয়ম মানতে থাকে এভাবে দিনের পর দিন।কিন্তু একদিন শোষণ, অন্যায় সহ্য করতে না পেরে ভয়কে হার মানিয়ে আজগর খাঁ এর বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলেন গ্রামের ইদ্রিস।
ইদ্রিস হলো গ্রামের রহমান মিয়ার পোলা। ইদ্রিস এর বয়স বিশ বছর। বুঝতেই পারছেন শরীরে বইছে তগবগে তেজি রক্ত। সে মানতে চাইনা কোনো অন্যায়। সে একের পর এক এই অন্যায়, অত্যাচার দেখে একদিন আজগর খাঁ এর মুখের উপর কথা বলে উঠলেন।
সেদিন ঠিক আগের মতো বিকাল পাঁচটায় ঘুমন্ত চেহারাটা নিয়ে হাজির হলেন আড়তে। সবাই আগের মতো দাড়িয়ে শুভ সকাল মালিক বলে সম্মান জানানো শুরু করল। কিন্তু আজগর খাঁ এর চোখ ইদ্রিস এর দিকে। ইদ্রিস দাড়ায়নি। আজগর খাঁ রাগান্বিত হয়ে বলেন কিরে ইদ্রিসচা দাড়াস নাই কেন? শুনেছি তুই নাকি আমার নিয়ম কানুন মানিস না। তুই কি শুরু করেছিস এসব। জ্বি মালিক বিকাল বেলা আপনাকে দাড়িয়ে শুভ সকাল বলতে আমার কেমন জানি লাগে বলল ইদ্রিস। তুই আবার মুখে মুখে তর্ক করিস আমার জন্য ঐ বিকাল বেলায় সকাল তোরা দাড়িয়ে তখনি আমাকে শুভ সকাল বলবি বুঝলি বান্দির বাচ্চারা রাগান্বিত হয়ে বললেন আজগর খাঁ। ইদ্রিস ও দাড়িয়ে বলে আমরা বান্দির বাচ্চারা আছি বলে আপনার আড়ত চলে কি বলেন আপনারা। আড়তের সবাই হ হ কথা ঠিক বলে আওয়াজ তুলল। ইদ্রিস এর সাহস দেখে গ্রামের অন্যদের ভয় কাটতে শুরু করল তারাও সাহসের সাথে একের পর এক অভিযোগ তুলতে শুরু করলো আজগর খাঁ এর বিরুদ্ধে।
আজগর খাঁ হেসে বলে বান্দির বাচ্চারা তোদের সাহসতো বেশ বাড়ছে দেখতেছি। আমার উপরে কথা কস তোরা। কাল থেকে আড়ত বন্ধ দেখি তোরা কি খাস কেমনে জীবনযাপন করিস। তা শুনে ইদ্রিস বলে উঠে আরে আপনার বন্ধ করতে হবেনা কাল থেকে আমরা বাহাত্তর ঘন্টা মানে তিনদিন হরতাল পালন করুম। আমরা তিনদিন আড়তে আসব না। তিনদিন ঘুমিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করব। আমি গ্রামের সবার উদ্দেশ্যে বলছি আপনারা কেউ আগামী তিনদিন আড়তে আসবেননা সবাই একটানা তিনদিন ঘুমিয়ে হরতাল পালন করবেন। এবং তারপরে বিকাল পাঁচটায় আড়তে আসবেন এবং সবাই ঐদিন হয়ে উঠবেন আজগর খাঁ এর মতে সম্মানিত ব্যক্তি। সবার সম্মান আছে সে হউক দরিদ্র বা বিত্তবান। আমরা সবাই মানুষ। আমরা সকলে সম্মানিত এসব বলতে লাগল ইদ্রিস।
এসব শুনে আজগর খাঁ রাগান্বিত হয়ে চলে গেলেন। পরেরদিন গ্রামে শুরু হয়ে গেলো ঘুমের হরতাল। পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। আড়তে তালা ঝুলছে। সবাই যার যার বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। এভাবে তিনদিন ঘুমোয় গ্রামের মানুষ। তারপর পাঁচটায় আড়তে আসলো সবাই। আড়তে এসে দেখে আজগর খাঁ বসে আছেন আড়তে। আজ তিনি দাড়িয়ে সবাইকে বলেন শুভ বিকাল। সবাইতো অবাক! অবাক হচ্ছো কেনো আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। জানিনা তোমরা আমাকে বিশ্বাস করবে কিনা এই তিনদিন আমি ঘুমাইনি সারাদিন সারারাত কাজ করেছি আড়তে। বিশ্বাস না হলে দেখ আড়তে একটি কাজও জমে নেই। আমি এতদিন তোমাদের সাথে অন্যায় করতাম। আমি বুঝেছি এখন সবাই সম্মানিত ব্যক্তি। সবার নিজ নিজ সম্মান আছে। তোমরা আমার আড়তে এতো কাজ করো আর আমি সারাদিন ঘুমিয়ে আসতাম এসে আবার তোমাদের সাথে অন্যায় করতাম। এই তিনদিনে তোমরা আমার চুখ খুলে দিয়েছো। আমি আমার ভুলটি বুঝতে পেরেছি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। বাবা ইদ্রিস তুই আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা না বললে কখনো আমি আমার ভুলটি বুঝতে পারতাম না। আমি আজ থেকে গ্রামের সবাইকে সম্মানের সহকারে দেখছি এবং বলছি আপনারা সবাই আজ থেকে মুক্ত, আপনারা আপনাদের ইচ্ছেমত সবকিছু করতে পারবেন। আজ থেকে গ্রামে আপনাদের জন্য আর্থিক লেনদেন শুরু। সবাই সবার মতো চলবেন। আমার দেয়া আর কোনো নিয়ম থাকবে না। এই বলে আজগর খাঁ বের হচ্ছেন আড়ত থেকে, তখন গ্রামের সবাই দাড়িয়ে যায় এবং বলে উঠে মালিক কাল আড়তে কয়টায় আসবেন? আজগর খাঁ সবার দিকে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিল এবং আড়ত থেকে চলে গেলো এই যাওয়াতে আর কোনোদিন ফিরে আসেননি আড়তে একেবারে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন আজগর খাঁ।
“ঘুমের হরতাল” গল্পের পোষ্টার। ছবি: লেখকের ব্লগ সাইট থেকে সংগৃহীত
সূত্র: লেখকের ব্লগ সাইট থেকে সংগৃহীত।