নিজস্ব প্রতিবেদক। অজানা বাংলাদেশ
আল ওমায়ের
অনিশ্চিত,অন্ধকার জীবন থেকে ফিরে এসেছে ৫টি বাহিনীর ৩৭ জন জলদস্যু। যাদের ছিলনা নিজের জীবনের প্রতি কোনো আস্থা। এইরকম অন্ধকার, অনিশ্চিত জীবন থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সাংবাদিক আকরাম হোসাইন। তার দারুণ প্রচেষ্টায় আজ তারা স্বাভাবিক জীবনে জীবনযাপন করছেন।গত ছয় মাস আগে জলদস্যূদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করে দেশের অন্যতম বেসরকারী টিভি চ্যানেল টুয়েন্টিফোর। তখন তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন আত্মসমর্পণের। তার ধারাবাহিকতায় গেল ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে ৬ টি জলদস্যূ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর ৪৩ জন সদস্য। যার মধ্যে ৫টি বাহিনীর ৩৭ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে আকরাম হোসাইনের অবদানে। আকরাম হোসাইনের অবদানে এই আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে শান্তি ফিরতে শুরু করেছে কক্সবাজার উপকূলে।চ্যানেল ২৪ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক আকরাম হোসাইনের বাড়ি কক্সবাজার জেলার পেকুয়ায়। সাংবাদিকতা পেশায় বেশী দিন না হলেও বুদ্ধিবিচক্ষণতায় অনেক দূর এগিয়েছেন।
যেসব দস্যু ও সন্ত্রাসীদের কারণে তটস্থ উপকূলের মানুষ, ওইসব মানুষগুলোকে কাবু করেছেন সাংবাদিক আকরাম। তার মাধ্যমেই অপরাধীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগটি কাজে লাগাবে। বিগত ৩ বছর ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি।
র্যাব ৭ এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন আহমদ, সিনিয়র এএসপি শাহেদা সুলতানা এবং মেজর মেহেদী হাসানের একান্ত সহযোগিতায় পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের জন্য প্রথম হওয়ায় একটু কঠিন ছিল। তবে চট্টগ্রামের সন্তান হওয়ায় দস্যুদের বুঝানোর প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক সহজ হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অধিকাংশ সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলেন। তাই তাদের সাথে আলোচনায় ভাষার মেলবন্ধন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল আকরাম হোসাইনের। ছয়টি বাহিনীর ৪৩ জনের মধ্যে আকরামের অবদানে আত্মসমর্পণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৫টি জলদস্যূ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর ৩৭ জন সদস্য। যা আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এব্যাপারে আকরাম হোসাইনের কাছে জানতে চাইলে তিনি অজানা বাংলাদেশ কে বলেন, এই অন্ধকার জগতের মানুষ গুলোর আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন খুবই কঠিন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তাদের আস্থা অর্জন করে এতগুলো বাহিনীর একসাথে আত্মসমর্পণ উপকূলে শান্তি ফেরানোর প্রথম ধাপ পার করলাম।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু সোনাদিয়া দীপের জাম্বুর সাথে ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে দেখা হয়। মূলতঃ স্থানীয় প্রশাসনের হাত থেকে বাচতে জাম্বু পার্বত্য জেলা বান্দরবানে অবস্থান করছিল।ঘটনাচক্রে জাম্বু যে একজন চিহ্নিত জলদস্যূ ও প্রশাসের তালিকাভুক্ত, তা জানতে পেরে তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। সম্পর্ক গভীর করি। তার মাধ্যমে অন্যান্য দস্যূদের সাথেও শুরু হয় যোগাযোগ। এভাবে দীর্ঘদিন তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করি।কারণ, এই অন্ধকার জগতের মানুষগুলো তাদের আপনজনকেও বিশ্বাস করে না। সেটি মাথায় রেখে তাদের মনমানসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। পরবর্তীতে তারা আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমিও তাদের বিশ্বাসের বীজটা আরো গভীরে পৌঁছানোর কৌশল ধরি। অনেকটা সক্ষমও হয়েছি। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালানোর পর ২০১৮ সালে তারা ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলতে রাজী হয়। এরপর তাদের নিয়ে চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের প্রতিবেদন তৈরির জন্যে তাদের প্রস্তাব দেই। এই প্রস্তাব দেওয়ার পর তাদের দলগত ভাবে মতপার্থক্য ছিল, অবিশ্বাস ছিল। আবার সেই অবিশ্বাস দূর করে আস্থা ফিরে আনার জন্যে সংগ্রাম শুরু করি । পরবর্তীদের তারা প্রতিবেদন তৈরিতে সম্মতি প্রকাশ করে। এর পর চ্যানেল টুয়েন্টিফোরে জল দস্যু নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। প্রতিবেদনে তাদের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরা হয়।প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বস্থ করা হয়, তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে আইনগত প্রক্রিয়ায় তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর দফায় দফায় আলোচনার মাধ্যমে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সম্মতি প্রদান করে। তাদের আলোচনার স্থানগুলো ছিল জনবিচ্ছিন্ন দুর্গম পাহাড় আর প্যারাবন। সেখানে নিজের সাথে সাথে কাউকে নেওয়া যায় না। তাদের দেওয়া লোকের সাথে অগ্রসর হতে হয়। মোবাইল নিয়ে যাওয়াও নিষেধ।কঠিন নিয়ম মেনেই যেতে হয় দস্যুদের আস্তানায়। কোনো কোনো সময় চোখ বেঁধে ফেলা হয়, যাতে পরবর্তীদের রাস্তা শনাক্ত করতে না পারি। ছিল অনেক গডফাদারের হুমকি আর প্রলোভন। তাদের রক্তচক্ষু আড়াল করে র্যাব-৭ কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাবস্থা করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তারিখ অনুযায়ী তাদের হেফাজতে নেয় র্যাব।
তিনি আরো বলেছেন যে জলদস্যু জাম্বুরা সাথে পরিচয় হয়েছিল সে ২০১৭ সালে র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন, তাকেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে শত বাধা ডিঙিয়ে গেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ৫টি বাহিনীর ৩৭ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তখন তারা ৯৪টি অস্ত্র ও ৭ হাজার ৬৩৭ টি গোলাবারুদ হস্তান্তর করেন।
শনিবার (২০ অক্টোবর) দুপুর ১২টার দিকে মহেশখালী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে র্যাব এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সেখানে মহেশখালীর আনজু বাহিনীর ১০ জন সদস্য, ২৪টি অস্ত্র, ৩৪৫ টি গোলাবারুদ, রমিজ বাহিনীর ২ জন, ৮ টি অস্ত্র ১২০ টি গোলাবারুদ, জালাল বাহিনীর ১৫ জন, ২৯ টি অস্ত্র ৬ হাজার ৭৯৮ টি গোলাবারুদ, আইয়ুব বাহিনীর ৯ জন, ৯টি অস্ত্র ৩৭ টি গোলাবারুদ ও আলাউদ্দিন বাহিনীর ১ জন, ১ টি অস্ত্র, ৪টি গোলাবারুদ ও নুরুল আলম ওরফে কালাবদা বাহিনীর ৬ জন ২৩ টি অস্ত্র, ৩৩৩ টি গোলাবারুদ হস্তান্তর করা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে- এসএমজি ১ টি, ব্রিটিশ ৩৪ রিভলবার ১টি, দেশি পিস্তল ২ টি, দেশি একনলা বন্দুক ৫২টি, দেশি দুই নলা বন্দুক ২টি ওয়ান শ্যুটারগান ১৯টি, থ্রি কোয়ার্টার ১৫টি ও ২২ বোর রাইফেল।
উপকূলে দাপিয়ে বেড়ানো ভয়ঙ্কর এই ছয় বাহিনী হলো- আনজু বাহিনী, রমিজ বাহিনী, জালাল বাহিনী, আইয়ুব বাহিনী, আলাউদ্দিন বাহিনী ও কালাবদা বাহিনী।
ছবি: আকরাম হোসাইন এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।জলদস্যুদের সাথে কথা বলছেন সাংবাদিক আকরাম হোসাইন।