
আরিফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। বাড়ছে স্বজনহারা মানুষের তালিকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ঘরে ঘরে বইছে নীরব কান্নার রোল, যেন দেখার কেউ নেই। অনেক পরিবার একমাত্র উপার্জনশীল মানুষটিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা। বাকরুদ্ধ সন্তানহারা মা। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে পড়েছে অভিভাবকহারা সন্তানদের। অসময়ে বিধবা হওয়া নারীদের কান্না থামছেই না। এমন দৃশ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত পরিবারগুলোতে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক-মহাসড়কে যান দূর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত পাঁচ মাসে এখানে সড়ক দূর্ঘটনায় নারী, পুরুষ ও শিশু সহ ৪০ জন নিহত হন। আর এখানে এসব দূর্ঘটনার নেপথ্যে মূলত রয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বেপরোয়া গাড়ি
চালনা, সড়কে নিষিদ্ধ যান চলাচল ও ফিটনেস বিহীন যানবাহন চলাচলে কোনো কার্যত প্রতিরোধ না থাকার কারণে।এদিকে গত কয়েকদিনে সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দুটি এখন নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার, সিএনজি চালিত অটো রিকশা, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক-অটোরিকশা, লেগুণা, মহেন্দ্রা সহ ফিটনেসবিহীন নিষিদ্ধ যানবহনের দখলে। যার ফলে এখানে ঘটছে একের পর এক সড়ক দূর্ঘটনা। অভিযোগ আছে, সরকারিভাবে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখানকার হাইওয়ে পুলিশের সাথে পরিবহন সংগঠনের অসাধু ব্যক্তি ও মালিকেরা মাসিক চুক্তির (মানথলি) বিনিময়ে মহাসড়কে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলে মহাসড়কে এসব অনিয়ম প্রকাশ্যে দেখেও পুলিশ সদস্যরা নীরবতা পালন করে আসছেন।
তবে এ ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে সড়কে দূর্ঘটনা বেড়েছে বিষয়টি স্বীকার করে জেলার সরাইল বিশ্বরোড মোড় খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ হোসেন সরকার বলেন, এখানকার মহাসড়কে নিষিদ্ধ যান চলাচলে মাসিক চুক্তির অভিযোগ সত্য নয়। তবে মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা সহ তিন চাকার যান চলাচলে পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কারণ স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন সহ রাজনৈতিক নেতাদের চাপ রয়েছে। তারপরও এতে আমরা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক জেলার আশুগঞ্জ থেকে শশই ইসলাম পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক বিশ্বরোড মোড় থেকে কুটি চৌমুহনী কালামোড়া সেতু পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার
এলাকা এই হাইওয়ে থানার অধীনে। সেই তুলনায় এই হাইওয়ে থানায় পুলিশ সদস্য কম। এখানে প্রয়োজন পুলিশের দুটি গাড়ি, কিন্তু গাড়ি আছে একটি। এখানে সরকারিভাবে কোন রেকার নেই। এছাড়া শুধু এখানকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩৩ কিলোমিটারের মধ্যেই ৪৩টি ফিডার রোড রয়েছে। এতো বিশাল এলাকা এই লোকবল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। হাইওয়ে ওসি আরো বলেন, এই হাইওয়ে থানায় মাত্র কনস্টেবল ৩০ জন, দারোগা একজন, সার্জেন্ট একজন, এ এস আই দুইজন, এ টি এস আই একজন, নায়েক দুইজন এবং ওসি পদে একজন রয়েছেন।
এদিকে এখানকার সড়ক-মহাসড়কে গত পাঁচ মাসে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া সড়ক দূর্ঘটনার প্রাপ্ত তথ্যমতে দেখা যায়, ২৮ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শাহবাজপুর রাজামারিয়া কান্দি এলাকায় সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন মোঃ সুবহান মিয়া নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়ি সরাইল সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামে। ২৩ জানুয়ারি কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে সদর উপজেলার সুহিলপুর মীরহাটি নামক স্থানে দিগন্ত পরিবহনের একটি বাস সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলে সাবু মিয়া (২৫) ও সাচ্চু মিয়া (৩২) নামে দুই মাছ ব্যবসায়ী নিহত হন। তাদের বাড়ি জেলা শহরের কান্দিপাড়া এলাকায়। ১৯ জানুয়ারি ভোরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিজয়নগর উপজেলার শশই এলাকায় বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই ব্যক্তি নিহত হন। তাৎক্ষণিক নিহতদের
পরিচয় পাওয়া যায়নি। ১৫ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিজয়নগর উপজেলার বীরপাশা এলাকায় একটি বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেলে হাসানুজ্জামান (৩২), পরশ কান্তি (৩৩), অপু আহমেদ (২৫), তার স্ত্রী ঝুমুর (২০) ও রিজন সালেহীন (৩০) নামে পাঁচ যাত্রী নিহত হন। তাদের বাড়ি ঢাকার খিলগাঁও এলাকায়। ১৩ জানুয়ারী দুপুরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে সদরের নন্দনপুর এলাকায় সড়কে রড বোঝাই সেলু মেশিনের ইঞ্জিন দ্বারা চালিত একটি পাওয়ার ট্রেইলর চাপা দিলে আল আমীন নামে এক শিশুর ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়। শিশুটির বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাকসাম এলাকায়। ৪ জানুয়ারি সকালে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে কসবা উপজেলার সৈয়দাবাদ এলাকায় মাইক্রোবাস চাপায় জহিরুল হক ভূঁইয়া (৭০) নামে এক
অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক নিহত হন।তিনি স্থানীয় বাদৈর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন গত এক বছর আগে। ২১ ডিসেম্বর ভোরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সদর উপজেলার রাধিকা এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক যাত্রী নিহত হন। তাৎক্ষণিক নিহতের পরিচয় জানা যায়নি। ২০ ডিসেম্বর দুপুরে নাসিরনগর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় গোকর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. হাসান খাঁ (৬৫) নিহত হন। ১৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা এলাকায় দু’টি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুইজন নিহত হন।নিহতদের নাম পরিচয় জানা যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর সকালে আখাউড়ায় অটোরিকশার ধাক্কায় সালাম মিয়া (৩৮) নামে এক শ্রমিক নিহত হন। তার বাড়ি পৌরশহরের দেবগ্রাম গ্রামে। ১৪
ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বিজয়নগরের চান্দুরা এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের চাপায় জনি (৭) নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। নিহত জনি চান্দুরা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামের ভুট্টু মিয়ার ছেলে। ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সদর উপজেলার সুহিলপুর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী বিষ্ণুপদ দেব (৬৬) ও তার স্ত্রী অঞ্জু রানী (৫৫) নামে দম্পতি নিহত হন। তাদের বাড়ি জেলা শহরের পূর্ব পাইকপাড়া এলাকায়। ১৫ নভেম্বর রাতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মেঘনা নদী ওপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর আশুগঞ্জ অংশে সড়কে একজনের মৃত্যু হয়। মরদেহটির উপর দিয়ে সারারাত গাড়ি চলাচল করায়, শরীরের উপর ও নিচের অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, মরদেহটি পুরুষ না নারী তা সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরদিন
সকালে অজ্ঞাত এই মরদেহের কয়েকটি অঙ্গ উদ্ধার করে হাইওয়ে পুলিশ। ১৪ নভেম্বর বিকেলে সদর উপজেলার আখাউড়া সড়কে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও ট্রাক্টরের মুখোমুখি সংঘর্ষে জালাল মিয়া (৩০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। ১২ নভেম্বর সকালে সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের উরশিউড়া এলাকায় সড়কে অটোরিকশার চাপায় মহিমা নামে ১৫ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়। মহিমা ওই এলাকার প্রবাসী আবুল হাসনাতের মেয়ে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সরাইলের বেড়তলা এলাকায় নির্বাচনী এক মোটরযান শোডাউনে সড়কে দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন দুই যুবক। এর মধ্যে কাউছার মিয়া নামে আহত যুবক চিকিৎসারত অবস্থায় ১০ নভেম্বর মারা যান। এর কিছুদিন পর অপর আহত যুবকও মারা যান।নিহত দুই যুবকের বাড়ি সরাইল সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামে।
১৫ অক্টোবর সকালে সদর উপজেলার নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের শালগাঁও এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় রাকিব মিয়া (১৭) নামে মোটরসাইকেলের এক আরোহী নিহত হন। ৯ অক্টোবর রাতে নবীনগর-কোম্পানিগঞ্জ সড়কে কড়ইবাড়ী এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা খাদে পড়ে বসু দেব ঋষি (৪০) নামে একব্যক্তি নিহত হন। ৪ সেপ্টেম্বর সকালে সরাইল উপজেলায় পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মাহি (১২) নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। নিহত মাহি উপজেলার আলীনগর এলাকার শাহ মোহাম্মদ ফুয়াদের ছেলে এবং নিজ সরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে সদর উপজেলার সুলতানপুর এলাকায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ফারুক মিয়া (৩০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।নিহত ফারুক চট্টগ্রাম জেলার পতেঙ্গা
এলাকার সবিউল আহমেদের ছেলে। ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে শহরের পশ্চিম মেড্ডা এলাকায় দিগন্ত পরিবহনের বাসের চাপায় সোহেল মিয়া (৩০) নামে এক পথচারী নিহত হন। নিহত সোহেল আখাউড়া উপজেলার মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ভাদুঘর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ট্রাকচাপায় কামাল মিয়া (৪০) নামে এক রিকশাচালক নিহত হন।নিহত কামাল ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার দওগ্রামের বাসিন্দা। ২৯ আগস্ট দুপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইল উপজেলার বৈশ্বামুড়া এলাকায় এনা পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি বাস খাদে পড়ে রোবিনা নূর (৫০), তার মেয়ে সাবিনা নূর (৩২), ইয়াছিন (৭ মাস)। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও ময়মনসিংহ এলাকায়। ২৭ আগস্ট সকালে আশুগঞ্জ উপজেলার
সোনারামপুর এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যানচাপায় মনোয়ারা বেগম (৫৫) নামে সিএনজি চালিত অটোরিকশার এক যাত্রী নিহত হন। নিহত মনোয়ারা বেগম উপজেলার যাত্রাপুর এলাকার নান্নু মিয়ার স্ত্রী। ১৮ আগস্ট দুপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসচাপায় শাহিদা বেগম (৪৫) নামে এক নারী নিহত হন। শাহিদা উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকার বাদল মিয়ার স্ত্রী। ১৫ আগস্ট বিকেলে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের উজানিসার এলাকায়
ট্রাকের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। তাক্ষণিক নিহতের পরিচয় মেলেনি। ১২ আগস্ট দুপুরে সরাইল উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিশ্বরোড এলাকায় চলন্ত ট্রাক থেকে
ছিটকে পড়ে সন্তোষ রায় (২৫) নামে এক যুবক নিহত হন। নিহত সন্তোষ হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার আদাঐর এলাকার হরি রায়ের ছেলে। ১০ আগস্ট রাতে দিগন্ত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় মানিক মিয়া (৩০) নামে এক অটোরিকশা চালক নিহত হন। কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পুনিয়াউট মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মানিক মিয়া সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়নের লোপাড়া গ্রামের হাদিস মিয়ার ছেলে।