হাসপাতাল থেকে বাবু খানের হাতে দুটো কাগজ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তিনি যে গাড়িটার চালকের পাশের সিটে বসেছেন, তার পেছনে তুলে দেয়া হয়েছে তার দুই পুত্রকে। দুই পুত্রও কথা বলছে না, তিনিও কথা বলছেন না। চালক এবং তার পাশে বসা এক পড়শীও কেমন যেন নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে কিছু লুকাতে চাইছেন! চোখ মুছে কী লুকাতে চাইছেন? অশ্রু? অশ্রু লুকাতে চাইছেন কেন? তারা কি কাঁদতে চাইছেন? কান্না লুকানোর কী আছে?
বাবু খান চিন্তা করেন, চালক আর তার পাশের জনের চোখ কেন টলমল করছে? তার চোখ যায় হাতে থাকা দুটো কাগজে। হাসপাতাল থেকে এ দুটো কাগজ দেয়ার সময় ভারী কণ্ঠে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ডেথ সার্টিফিকেট’। তখনো এ কাগজের অর্থ হয়তো পুরোপুরি বোঝেননি বাবু খান। যখন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে তার দুই পুত্র আমির খান (৩০) ও হাশিম আলীকে (১৯) অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হলো, তখন বাবু খান বুঝলেন, এ কাগজ তার দুই সন্তানের ‘মৃত্যুর ঘোষণাপত্র’।
প্রিয় কারও মৃত্যুতে মানুষ বুকফাটা আর্তনাদ করলেও বাবু খান তার দুই পুত্রের চিরবিদায়পত্র হাতে পেয়েও তেমন কিছু করলেন না। বুকের বাঁ পাশটা কেবল চিনচিন করেছে, আর মনের অজান্তে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছে দুফোটা জল।
দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুস্তাফাবাদে দাঙ্গা বাঁধিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অন্য সংখ্যালঘু মুসলিমদের মতোই বাবু খানের এই দুই পুত্রকে মারতে মারতে নিথর করে ফেলে। পরে তাদের গুরু ত্যাগ বাহাদুর হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর শনিবার আমির ও হাশিমের মরদেহ বুঝিয়ে দেয়া হয় তাদের বাবা বাবু খানকে।
অ্যাম্বুলেন্সে দুই পুত্রের মরদেহ এবং হাতে তাদের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে বাড়ি ফেরেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বাবু খান। দাঙ্গাবাজদের আগুনে বিপর্যস্ত বাড়িতে দুই মরদেহ ঢুকতেই শুরু হয় আহাজারি। এই আহাজারিতে যেন আশপাশের আকাশ-বাতাসও ভারী হয়ে ওঠে। আমিরের দুই কন্যাশিশুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে প্রতিবেশীদের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ে চোখের পানি নামাজে জানাজা শেষে আমির ও হাশিমকে নিয়ে যাওয়া হয় দাফন করতে।
দুই কাঁধে দুই সন্তানের মরদেহ নিয়ে
কবরস্থানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাবু খান বোঝেন তার চোখও ছলছল করছে। সেই অশ্রু লুকাতে বাবু খান আকাশে তাকান। তিনি যেন উত্তর খোঁজেন ওপরে,
হে আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেলিলে আমাকে জানিনা কি লিখেছ আমার কপালে ধৈর্য ধারণ করিয়া তোমারি কাছে বিচার দিলাম।