
আরিফুল ইসলাম সুমন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
পরিবারের এক সদস্য একই পরিবারের অন্য সদস্যকে কীভাবে হেনস্থা করা যায়, অন্যের সংসার কীভাবে ভাঙা যায়, পিতা ও মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক কীভাবে নষ্ট করা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর দ্বন্দ্ব কীভাবে সৃষ্টি করা যায়- এসব মন্ত্র এখন হিন্দি টেলিভিশন সিরিয়াল থেকেই আমাদের সমাজে ঢুকছে।
সাম্প্রতিককালে নাগরিক জীবনে টেলিভিশন মানেই যেন হিন্দি সিরিয়াল। পরিবারের মা, বোন, চাচিরা এখন টেলিভিশন বলতে শুধু হিন্দি সিরিয়ালই বোঝেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব চ্যানেলে চলতে থাকে বিভিন্ন নামের ধারাবাহিক টিভি সিরিয়াল। আর সিরিয়ালের ফাঁদে পড়ে আমাদের নারীসমাজ পরিবার-পরিজন কিংবা সামাজিক জীবনের সাধারণ দায়িত্বগুলো থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। এসব সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিজেদের মাঝেও তারা আয়ত্ত করতে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। ফলে এই সিরিয়াল থেকেই সমাজে পরকীয়া, বহুবিবাহ কিংবা বাঙালি বহু বছরের ঐতিহ্যগত চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্কের মাঝে দেখা দিয়েছে ভাঙন।
ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের প্রভাবে আমাদের সমাজ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার কিছু ঘটনা উপস্থাপন করা হলো-
ঘটনা-১ > সন্ধ্যা ছয়’টা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল সদরের বাসিন্দা মহসিন আহমেদ কেবল অফিস থেকে ফিরে ওয়াশ রুমে ঢুকেছেন। স্ত্রীর চিৎকারে ঠিকমতো ফ্রেশ হতে পারেননি বেচারা। তড়িঘড়ি বাইরে এসে দেখলেন তাদের একমাত্র দেড় বছর বয়সী বাচ্চা “অহনা” কাঁদছে। মহসিন সাহেবকে তার স্ত্রী বললেন বাচ্চাকে নিয়ে অন্য রুমে বসে একটু খেলতে, কারণ স্টার জলসায় শুরু হয়ে গেছে ‘টাপুর-টুপুর’ নামের সিরিয়ালটি। আজকের পর্বটি নাকি অনেক আকর্ষণীয়, নতুন কিছু ঘটবে বলে জানান তার স্ত্রী। অগত্যা মহসিন সাহেব কথা না বাড়িয়ে মেয়ের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
ঘটনা-২ >ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুপার মার্কেটে পরিবার নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ এলাকার মাসুদুর রহমান। সবার পোশাক পছন্দ হলেও তার ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে কোনো পোশাকই পছন্দ করছে না। কারণ তার পছন্দ ‘ঝিলিক’ নামের একটি পোশাক, এটা ছাড়া আর কোন কিছুই সে কিনতে নারাজ। তার এক কথা, ঝিলিক জামা লাগবেই। রহমান সাহেব অনেকটা অসহায়ের দৃষ্টি নিয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে ওই নামের পোশাকটি এখানে নেই। পোশাকটি পরে কিনে দেয়া হবে।
ঘটনা-৩ > সরাইলের একটি হাই স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ে সাথী। প্রতিদিনই একটি বিষয় নিয়ে বাবা-মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়। যে যত কথা বলুক না কেন ‘রাশি’ নামের একটি বাংলা এবং স্টার প্লাসের ‘শ্বশুরাল গেন্দা ফুল’ হিন্দি সিরিয়ালটি তাকে দেখতে দিতেই হবে। পরীক্ষা কিংবা বাসায় প্রাইভেট শিক্ষক পড়াতে এলেও সেটাতে তার মনোযোগ থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দি সিরিয়াল দেখার কারণে এখন তাকে অধিকাংশ সময়ই হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যায়। এমনকি সিরিয়ালের বিভিন্ন ডায়ালগ মুখস্থ করে রেখেছে সে। অন্যদিকে পরীক্ষার রেজাল্ট যথেষ্ট খারাপ হয়েছে।
” বাংলাদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেল এখন কোণঠাসা”
স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, জিটিভি, স্টার ওয়ান, সনি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মধ্যে বাংলায় প্রচারিত সিরিয়ালের অাধিপত্যে বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বাঙালি নারীদের কাছে টেলিভিশন বলতে এখন এসব চ্যানেলের সিরিয়ালই বোঝাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অনেকটাই আজ হুমকির সম্মুখীন।
“ভেঙে পড়ছে সামাজিক সম্পর্ক”
স্টার প্লাস, স্টার ওয়ানের এই হিন্দি সিরিয়ালের কারণে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা। টিভি সিরিয়ালগুলোর বাস্তবতা বিবর্জিত কাহিনী আর চরিত্রের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষ, চক্রান্ত কিংবা অপরাধপ্রবণ বিষয় আমাদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে। আগে যেখানে সন্ধ্যার পর পরিবার-পরিজনের সবাই মিলে একসঙ্গে গল্পগুজব করত, সবাই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করত, সেখানে এখন এই হিন্দি সিরিয়াল দেখে মানুষ শিখছে কীভাবে অন্য পরিবারের ক্ষতি করা যায় কিংবা বউমা তার শাশুড়িকে বা শাশুড়ি বউমাকে শায়েস্তা করে তার নানান ফন্দি। প্রতিটি সিরিয়ালে দেখানো এই পরকীয়া বা ডিভোর্সের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে বাঙালি নারীরা। তার পরেও সরকারিভাবে কোন ধরনের বন্ধের ব্যবস্থা কিংবা উপযুক্ত গবেষণা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
“দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সিরিয়াল”
হিন্দি সিরিয়ালগুলোয় এমন সব বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে যাতে আমাদের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন আগে প্রতিটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ায় স্টাইল ছিল ঠিক বাঙালিয়ানা, কিন্তু এখন উৎপাদন আর চাহিদার মাঝে সামঞ্জস্য থাকছে না, নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে হিন্দি ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে।