
মাহমুদুল হাসান: টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্বর্ণগর্ভা ‘টাঙ্গাইল’- এর আজ ১৪৯তম জন্মদিন তথা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আজ থেকে ১৪৮ বছর আগে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর ‘আটিয়া’ থেকে মহকুমা সদর দপ্তর টাঙ্গাইলে স্থানান্তর করা হয়। মূলত: ওই সময়টাকেই ‘টাঙ্গাইল’- এর প্রতিষ্ঠাকাল বা জন্মদিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
নদী-চর-খাল-বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুফাখখারুল ইসলাম তার ‘টাঙ্গাইল জেলার সাধারণ ইতিহাস প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর কাশিম নওয়াব হওয়ার পর খাজনা আদায়ের যে নতুন বন্দোবস্ত করেন তার আওতায় টাঙ্গাইল অঞ্চলের আটিয়া, কাগমারী, বড়বাজু, হোসেনশাহী ইত্যাদি পরগনার দায়িত্ব চারজন মুসলমান তালুকদার প্রাপ্ত হন। পূর্ব থেকেই কাগমারীর জমিদার ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান ইনায়াতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী। তার বাড়ি ছিল বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের উত্তর-পশ্চিম কোণে। তার নামানুসারেই এলাকাটির নাম এখন পর্যন্ত ইনায়াতপুর।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে আটিয়া, পিংনা ও মধুপুর থানা সমন্বয়ে আটিয়াকে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। এরপর আটিয়া মহকুমা সদর টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হলে আটিয়া মহকুমা নামটির বিলুপ্তি ঘটে।
বলাযায়, বাণিজ্যিক নৌপরিচালনার সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপবিদ ও প্রকৌশলী জেমস রেনেলকে বঙ্গীয় নদীব্যবস্থার জরিপ ও এর মানচিত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রেনেল ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের তরফে বাংলার এক সেট মানচিত্র প্রস্তুত করেন। তাঁর ১৭৭৯ সালে মুদ্রিত বেঙ্গল এ্যাটলাস (Bengal Atlas) বাণিজ্যিক, সামরিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে একটি অতিমূল্যবান কাজ। শিক্ষামূলক, প্রশাসনিক ও নৌ-পরিচালনা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্য উনিশ শতকে পেশাগত মানচিত্রের আত্মপ্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত রেনেলের মানচিত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য নির্দেশক ছিল।
টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে উইকিপিডিয়া বলছে, বহু জনশ্রুতি ও নানা মতামত রয়েছে। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে।
খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের ইতিহাস প্রণেতা’টাঙ্গাইলের ইতিহাস’ গ্রন্থে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে টান শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইল।
টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়ে আরো বিভিন্নজনে বিভিন্ন সময়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন।
কারো মতে, নবাব মুর্শিদকুলী জাফর খাঁর আমলে টাঙ্গাইল ছিল কাগমারী পরগনার অন্তর্গত। জমিদার ইনায়াতুল্লাহ খাঁ লৌহজং নদীর টানের (উঁচু) আইল দিয়ে যে পথে ক্রোশখানেক পশ্চিম-দক্ষিণে খুশনুদপুর কাছারিতে যাতায়াত করতেন সেই ‘টানের আইল’ শব্দটি উচ্চারিত হতে হতে ‘টান-আইল’ এবং পরে রূপান্তরিত হয়ে ‘টাঙ্গাইল’ হয়। পরবর্তী সময় ইনায়াতুল্লাহ খাঁর কাগমারী জমিদারী বেদখল হয় এবং জবরদখলকারীদের কারসাজিতে খুশনুদপুর নামটি ‘সন্তোষ’ হয় বলে জানা যায়।
আবার কারো কারো মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র যখন আটিয়াতে স্থাপন করা হয় তখন এই অঞ্চল জমজমাট হয়ে উঠে। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন- যাকে বর্তমান টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত টাঙ্গা বা টমটম, ‘টাঙ্গা’ শব্দটি মূলত: ঘোড়ার গাড়ি চালকরা বেশি ব্যবহার করত এবং ঘোড়ার গাড়ি চালকদের টাঙ্গা বা টাঙ্গাওয়ালা বলা হত। ইতিহাসবিদদের একটি ভ্রান্ত ধারণা উপস্থাপন যুক্তিযুক্ত ; তা হলো- অনেকেই বলেন ঘোড়ার গাড়িকে ‘টাঙ্গা’ বলা হত। কিন্তু মূলত: তা নয়- ঘোড়ার গাড়ি চালককে বলা হত ‘টাঙ্গা’ বা টাঙ্গাওয়ালা। এই টাঙ্গাওয়ালারা ঘোড়ার গাড়িকে বেশির ভাগ সময় লাগাম ধরে টেনে বা লাগাম হাতে হেটে হেটে গন্তব্যে পৌঁছত। এ প্রসঙ্গে বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলের ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম গাড়ির চলাচল স্থল পথে সর্বত্র ছিল। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়। আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল। একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়।
টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে টাঙ্গা+আইল এভাবে যোগ করে হয়েছে টাঙ্গাইল, এ মতটি অনেকে পোষণ করেন। আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিক ভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে টান আইল বলা হ