
আরিফুল ইসলাম সুমন, স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে টানা দুইদফা এমপি ছিলেন জিয়াউল হক মৃধা। বিগত দশ বছরে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নকাজ করিয়েছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও এই নির্বাচনে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজয়বরণ করেছেন। আর তার এই পরাজয় নিয়ে এলাকায় নানা আলোচনা অব্যাহত আছে।জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে “ধানের শীষ” প্রতীকের হেভিওয়েট প্রার্থী ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত করে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে “লাঙ্গল” প্রতীকে বিজয়ী হয়ে এমপি হন জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা। দশম জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নায়ার কবীরকে পরাজিত করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে “ধানের শীষ” প্রতীকের প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূইঁয়ার কাছে এখন অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হয়েছেন জিয়াউল হক মৃধা। তবে তার এই ভরাভুবি নিয়ে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন মহলে নানা প্রতিক্রয়া চলছে। জিয়াউল হকের এই পরাজয়ের নেপথ্য কারণ জানতে গেলে নানা তথ্য উঠে আসে।অনুসন্ধানে জানা যায়, টানা দশ বছর এই আসনটি মহাজোটের দখলে ছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের গণজোয়ারের মধ্যেও শুধুমাত্র সাংসদ জিয়াউল হক ও তার বড় মেয়ের জামাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের যুব বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম
ভূইঁয়ার ভুলের কারণেই এই আসনটি হাতছাড়া হয়েছে। এমন অভিযোগ খোদ স্থানীয় মহাজোটের নেতাকর্মী ও সমর্থক অনেকের। যদিও এই আসনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হয়নি।নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই আসনের তিনটি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল স্থগিত থাকায় চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। আসনটির ১৩২ কেন্দ্রের মধ্যে বাকি ১২৯ কেন্দ্রের ফলাফলে এগিয়ে আছে বিএনপি। ধানের শীষের প্রার্থী আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া পেয়েছেন ৮২ হাজার ৭২৩। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মাঈন উদ্দিন মঈন পেয়েছেন ৭২ হাজার ৫৬৪ ভোট। স্থগিত ঘোষণা করা ওই তিন কেন্দ্রে মোট ভোট ১০ হাজার ৫৭৪। স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মাঈন উদ্দিন
পিছিয়ে আছেন ১০ হাজার ১৫৯ ভোটে।
স্থগিত কেন্দ্র তিনটি নির্বাচনী এলাকা আশুগঞ্জ উপজেলার যাত্রাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোহাগপুর দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাহাদুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আগামি ৯ জানুয়ারী এই তিন কেন্দ্রের পুনরায় ভোট গ্রহণ হবে।এই বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার সাংবাদিকদের জানান, ‘জাতীয় পার্টির ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
অথচ তাদের প্রার্থী কে তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় ভোটের এক দিন আগে পর্যন্ত। আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী কে তা আগে থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলে জেতা সহজ হতো। কিন্তু সেটি না হওয়ায় নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে কাজ করতে পারেনি। তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল বলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় জিয়াউল হক মৃধাকে। তবে তার মেয়ের জামাই’র নাটকীয়তায় দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ভোটের মাঠে টিকে থাকতে তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। যদিও পরবর্তীতে দলের নতুন মহাসচিব মোঃ মসিউর রহমান রাঙ্গা, জিয়াউল হককে মহাজোটের প্রার্থী দাবি করে
নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেন। তবে আইনি জটিলতায় তিনি মার্কা পান “সিংহ”।অপরদিকে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে “লাঙ্গল” প্রতীকে নির্বাচনে মহাজোটপ্রার্থী দাবি করে শ্বশুরের বিপক্ষে লড়েন রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। তবে নির্বাচনের আগের দিন শ্বশুর জিয়াউল হককে সমর্থন করে সরে দাঁড়ান রেজাউল ইসলাম ভূইঁয়া। ভোটের শেষমুহূর্তে জামাই সরে দাঁড়ালেও সিংহ প্রতীকের শ্বশুর তেমন ভালো ফল করতে পারেননি।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন স্বাক্ষরিত প্রাথমিক ফলাফল বিবরণী থেকে জানা গেছে, জিয়াউল হক মৃধা পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৩০৫ ভোট। সরে দাঁড়ালেও লাঙল প্রতীকে
প্রার্থী রেজাউল ইসলাম পেয়েছেন ২৭৯ ভোট।এদিকে তৃণমূলে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও জিয়াউল হকের পরাজয় নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মহাজোটের এমপি হয়েও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ত্যাগী নেতাদের প্রতি সন্দেহ-অবমূল্যায়ন, দলীয় কিছু সুযোগ সন্ধানী নেতার প্রতি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর নিজ দলের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার অসহযোগিতার কারণেই জিয়াউল হককে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।স্থানীয় আওয়ামী লীগের জিয়াউল অনুসারীদের দাবি, বিগত দুটি নির্বাচনে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে জিয়াউল হক বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এইবার প্রকাশ্যে বিরোধীতা থাকার কারণে জিয়াউল বিজয়ী হতে পারেননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জিয়াউলের পরাজয়ের নেপথ্যে মূলত দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের বিরোধীতা ও তার নির্বাচন পরিচালনার ব্যর্থতা দায়ী। এছাড়াও প্রয়োজনীয় নির্বাচনী খরচ দিতেও তিনি অনেকটা ব্যর্থ হন। নির্বাচনী কৌশলেও তার ভুল ছিল নানা জায়গাগুলোতে। জিয়াউল হকের নির্বাচনী নানা কৌশল খুব সহজেই তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কাছে পৌঁছে যেত, এমন কয়েকজন লোক সর্বক্ষণ জিয়াউল হকের কাছেই থাকতো। কয়েকজন সারাদিন জিয়াউল হকের সাথে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাই। আবার তারাই রাতের আধারে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর সাথে গোপন বৈঠক করে। এসব বিষয়ে জিয়াউল হকের তেমন নজর ছিল না।
জিয়াউল অনুসারীদের মতে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ সহ ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখাটা ছিল টানা দুইবারের এমপি জিয়াউল হকের বড় ধরনের ভুল। জেলা ও উপজেলা জাতীয় পার্টির কয়েকজন ত্যাগী নেতার সাথেও তার দূরত্ব ছিল চোখে পড়ারমতো। মহাজোটের তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও তিনি বেশী কাছে টানতেননা। যেইকারণে তাদের বড় অংশের অনেকেই এই নির্বাচনে জিয়াউল হকের বিরোধীতা করেছেন প্রকাশ্যে।
এছাড়া বিগত উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপি হিসেবে জিয়াউল হকের যেই ভূমিকা ছিল, এসব নিয়েও এই জাতীয় নির্বাচনে
নানা প্রভাব ফেলেন কেউ কেউ।জিয়াউল হকের নির্বাচনী অনুসারীদের মতে, এবারের নির্বাচনে জিয়াউল হকের “সিংহ” প্রতীকের পক্ষে নির্বাচন পরিচালনায় যারা প্রধান ভূমিকায় ছিলেন, আওয়ামী লীগের ও জাতীয় পার্টির সেইসব শীর্ষ নেতাদের কেন্দ্রে “সিংহ” প্রতীকের সমালোচিত পরাজয় ঘটেছে। এর কারণ তারা পুরো নির্বাচনী এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালালেও নিজ নিজ এলাকায় “সিংহ” প্রতীকের প্রচারণায় পিছিয়ে ছিলেন।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ও নোয়াগাঁও এই দুই ইউনিয়ন জিয়াউল হকের ঘরানার। অথচ দু’তিন কেন্দ্র ছাড়া এই দুই ইউনিয়নের সবকটি কেন্দ্রে “সিংহ” প্রতীকের ব্যাপক ভরাডুবি হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, জিয়াউল হকের নিজ ইউনিয়ন কালীকচ্ছে কাঙ্খিত ভোট পড়েনি “সিংহ” প্রতীকে। জিয়াউল হক মৃধার সমর্থনে “লাঙ্গল” প্রতীকে কালীকচ্ছ ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় জাপা’র নেতা মোঃ শরাফত আলী। আবার চাঁনপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ শামসু মিয়া কালীকচ্ছ জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক। অথচ সেই চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে জিয়াউল হকের “সিংহ” প্রতীক পেয়েছে মাত্র ১৩৪ ভোট। আর এ কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৫৯৬ ভোট পেয়েছে “ধানের শীষ”। এদিকে কালীকচ্ছ ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি মোঃ জজ মিয়ার বাড়ির ধর্মতীর্থ কেন্দ্রে ” সিংহ” প্রতীক পেয়েছে ৫৪২
ভোট। আর এ কেন্দ্রে ১০৭৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে “ধানের শীষ”।জিয়াউল হক মৃধার জন্মভূমি ও বাপ-দাদার স্মৃতি বিজড়িত নোয়াগাঁও গ্রামের কেন্দ্রে ” সিংহ” প্রতীক বিজয়ী হয়নি। তবে তাঁর বর্তমানে বাসভূমি কালীকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অন্যান্য প্রতীকের চেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছে “সিংহ” প্রতীকের।জিয়াউল হক মৃধার সমর্থনে নির্বাচনে প্রচারণায় অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন, কালীকচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একাধিকবার নির্বাচিত জনপ্রিয় নারী সদস্য ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মোছাঃ রোকেয়া বেগম। অথচ রোকেয়া বেগমের কেন্দ্রে “সিংহ” প্রতীক জয়ী হতে পারেনি। জিয়াউল হকের
শ্বশুরবাড়ি এলাকা সরাইল সদরের সৈয়দটুলা গ্রামের দুটি কেন্দ্রেই “সিংহ” প্রতীকের পরাজয় হয়েছে। সেই দুই কেন্দ্রে “ধানের শীষ” বিজয়ী হয়েছে।জিয়াউল হকের এই নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন সরাইল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্জ্ব রফিক উদ্দিন ঠাকুর। অথচ এই নেতার বাড়ির কুট্টাপাড়া গ্রামের দুইটি কেন্দ্রেই “ধানের শীষ” প্রতীক বিজয়ী হয়েছে। এই দুই কেন্দ্রে পরাজয় হয়েছে “সিংহ” প্রতীকের।অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অদূরদর্শিতা ও উদাসীনতার কারণে যাদেরকে জিয়াউলের এজেন্ট নিয়োগ করেছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন
বিএনপি সমর্থক। এছাড়া ভোটের দিন উপজেলা সদরের অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, কুট্টাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র সহ কয়েকটি কেন্দ্রে অনেকে বুকে “সিংহ” প্রতীকের ব্যাজ ঝুলিয়ে কৌশল খাটিয়ে গোপনে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করে জিয়াউল হকের পরাজয়কে তরান্বিত করেছে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নানা অযৌক্তিক বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশ করিয়ে জিয়াউল হকের পরিছন্ন নির্বাচনী মাঠকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে চিহ্নিত কয়েকজন।