আরিফুল ইসলাম সুমন, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে ।
অজানা এক জীবনপথে এগিয়ে চলেছেন জীবনসংগ্রামী নাজমা বেগম। ত্রিশ বছর বয়সী এই স্বামী পরিত্যক্তা নারী শুধুই বাঁচার তাগিদে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ সন্তানের জননী এই অসহায় নারীর আশ্রয়দাতা-স্বামী বেচারা বছরদু’য়েক আগে পরকীয়ায় পড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। এখন তিন শিশু কন্যা ও দুই পুত্র সন্তান নিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন, খালা-ফুফু সর্বাত্মীয়হারা এতিম-অসহায় নাজমা বেগম দুঃখের সাগরের অথৈ হাওয়ায় ভাসছেন। দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নেই। তারওপর একমাত্র মাথাগুজার ঠাঁই ঘরটির বেহাল দশা, এটি বসবাসের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রাতে ঘনকুয়াশা অথবা সামান্য বৃষ্টি হলে পরিবারটির সবাইকে ঘরটির এককোণে বসে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের নন্দীপাড়া গ্রামের বাবু’রমন্দির এলাকায় পৈতৃকসূত্রে ও মায়ের রেখে যাওয়া অতি সামান্য একটু জায়গায় অসহায় নাজমা বেগম ও তার সন্তানেরা স্থান পেলেও সেইখানে তাদের মাথাগুঁজার ঠাঁই হিসেবে যেই ঘরটি রয়েছে, এটির অবস্থা একেবারেই নাজুক পরিস্থিতি’র। ঘরটির চারিদিকে বেড়া ভাঙ্গা, বাঁশের খুঁটিগুলি নড়বড়ে অবস্থা। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি এখনই ঘরটি ভেঙ্গে পড়ে মাটিতে গুঁড়িয়ে যাবে। দু’মুঠো ভাত জোগাড়ের ব্যবস্থা নেই, আবার ঘর মেরামত করা, এ যেন নাজমার জন্য পাহাড় সমান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘরের প্রসঙ্গ আসতেই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে নাজমা বেগম। এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কিছুদিন আগে শুনেছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরীবের জন্যে বিনামূল্যে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। বুকে প্রচন্ড আশা নিয়ে প্রথমে স্থানীয় মেম্বার এবং পরে চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে সরকারি ঘরের জন্য আবেদন জানাই। তবে এই ঘর পেতে তারা যেই শর্ত দিয়েছে, তা শুনেই ঘরের খায়েশ’ আমার মিটে গেছে। ভাত কিনে খাওয়ার সামর্থ নেই, তাদের (মেম্বার -চেয়ারম্যান) শর্ত পূরণ করবো কোথা থেকে।
নাজমা বেগম বলেন, একটি ভিজিটি কার্ডের জন্য বহুদিন ঘুরেছি, শর্ত পূরণ করতে পারেনি কার্ডও পাইনি। তবে অনেক কান্নাকাটির পর সরকারি রাস্তায় ৪০ দিনের মাটি কাটার কাজ
(অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি) পেয়েছি। সকাল আট’টা থেকে দুপুর পর্যন্ত মাটি কাটতে হয়। দৈনিক দুইশত টাকা হাজিরা। কিছুদিন পর পর একসাথে টাকা দেয়। সেই টাকা থেকেও মেম্বার ও অফিসের লোকেরা মাষ্টাররোল ও অন্যান্য খরচ দেখিয়ে টাকা কেটে রাখে। এসবে সংসার একেবারেই চলে না। সারাদিনে রাতে একবেলা ভাত খাই, এতেও সন্তানদের পেটপুরে ভাত দিতে পারিনা। ছোট ছোট শিশু বাচ্চারা ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে শুরু করে। তখন প্রতিদিন রাত দশ’টার দিকে কালীকচ্ছ বাজার এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে ছোট দুই শিশু মেয়ে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ওইখানকার লোকদের রাতের খাবার শেষ হলে অতিরিক্ত খাবারগুলো চেয়ে মেয়েরা নিয়ে আসে। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে তাদের ছোট ভাই-বোন ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপরও মেয়েরা ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে তাদের এ ভাত খাওয়ায়।অসহয় নাজমা বেগম আরো বলেন, আমার বড় মেয়ে সুখী। যেই বয়সে সে বই, খাতা ও কলম নিয়ে স্কুলে যাবার কথা, সেই বয়সে শিশু সুখীর ঘাঁড়ে এখন চেপে বসেছে সংসার চালানোর দায়িত্ব। তাইতো আট বছর বয়সের সেই সুখী বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভিক্ষাবৃত্তির কাজ করতে হচ্ছে গত কয়েকমাস যাবত।জানা গেছে, সংসারে উপার্জনশীল পুরুষ লোক নেই, তাই এখন সংসারের ঘানি টানার দায়িত্ব পড়েছে বড় সন্তান হিসেবে সুখী এবং তাদের মাতা হিসেবে নাজমা বেগমের কাঁধে। ভূমিহীন পরিবার, অভাবের সংসার তাই-তো অসহায় মা ও মেয়ে ভাগাভাগি করে এ সংসার চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
স্বামী পরিত্যক্তা নাজমা বেগম দৈনিক দুইশত টাকা চুক্তিতে দিনমজুরী দিয়ে সংসারের চাল, ডাল ও পরিবারের অন্যান্য চাহিদা মেটান। আর সুখীর দায়িত্ব হলো পরিবারের সদস্যদের দু’মুঠো ভাতের তরকারি’র জোগান দেয়া। এই বয়সে কায়িকশ্রমে টাকা রোজগার সম্ভব নয়, তাই সুখী প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সদরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দু’হাত বিছিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি পেশা বেছে নিয়েছে। তরকারি’র জন্য “আলু ও পাঙ্গাস মাছ” কেনার টাকা জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত সুখী বাজারে বাজারে বিভিন্ন মানুষের কাছে দুই হাত বিছিয়ে সাহায্য চাইতেই থাকে।এদিকে দু’চোখের কোণে অশ্রু জ্বলজ্বল করছিল আর সুখী বলছিল, পিতা বশির মিয়া অন্যত্র বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের কোনো খোঁজ খবর নেন না তিনি।
অভাব অনটনের সংসারে সুখী সহ তার অন্যান্য ছোট ভাই ও বোনের ভরণ-পোষনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছেন তাদের মা নাজমা বেগম। এছাড়া তাদের এখন আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউই নেই। নানা, নানী, মামা, খালা কেউই না থাকায় নানীর রেখে যাওয়া একটু জায়গায় একটি ভাঙ্গা টিনশেড ঘরে তাদের বসবাস। সংসারের আর্থিক ব্যয়ভার বহনে প্রতিদিন মাটিকাটার কাজ করে দুইশত টাকা রোজগার করেন সুখীর মা। তা দিয়ে সংসার চলে না, তাই পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরেছে সুখী। সে তার মায়ের সম্মতিতেই বাজারের ব্যাগ নিয়ে প্রতিদিন সাহায্যের জন্য বেরিয়ে পড়ে। সারা দিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরে অন্তত একশ’ টাকা হলেই ‘আলু আর ছোট পাঙ্গাস মাছ’ কেনা হয়ে যায়। প্রতিদিন মা বিকেলে কাজ থেকে ফিরে এসে ভাত রান্না করে
রাখেন। আর সুখী সন্ধ্যায় বাজার করে বাড়িতে ফিরলে, তরকারি রান্না শেষে তাদের খাওয়া-দাওয়া হয়। আবার পরদিন সকালে মা ও মেয়ে জীবনযুদ্ধে বেরিয়ে পড়ে। এভাবেই চলছে তাদের জীবনযাত্রা।জীবন সংগ্রামী সুখীর – চুমকী (৭), সুমাইয়া (৫) নামে দুই বোন ও আমিন উল্লাহ (৬) ও আব্দুল্লাহ (১) নামে দুই ভাই রয়েছে।তবে এদের মধ্যে ছোট বোন সুমাইয়াকে নিয়ে কিছুদিন আগে সুখী সাহায্য চাইতে বেরিয়ে ছিল। পথিমধ্যে সুমাইয়া সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়। এই কথাটি বলতে গিয়ে সুখী কাঁদতে শুরু করে। এখন অভাবের তাড়নায় ছোট ভাই আমিন উল্লাহকে সঙ্গে নিয়েই আর্থিক সাহায্যের জন্য প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সুখী। উপজেলা সদরের কালিকচ্ছ বাজার ও সরাইল সদর বাজারসহ আশপাশ এলাকায় ঘুরে বেড়ায় সুখী ও তার ছোট ভাই। দুপুরে
রাস্তায় তাদের পুরি-সিঙ্গারা খেয়েই দিন চলে যায়। সারাদিনে ১০০টাকার মত সাহায্য পেয়ে রাতে এশার নামাযের আযানের পরে বাড়ি ফিরে এই দুই ভাই-বোন।তাদের পড়ালেখা করার ইচ্ছে হয় কি না ? এমন প্রশ্নের জবাবে আবারো কাঁদতে শুরু করে সুখী। সে জানায়, লেখাপড়া করতে খুব ইচ্ছে হয় তার। সুখীর ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করে সে ডাক্তার হবে। এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রতিদিন ‘আলু আর পাঙ্গাস মাছ’ কিনতে পুরনো বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে সাহায্যের জন্যে দুই হাত বিছিয়ে চলেছে সুখী ও তার ভাই।জানিনা সুখী’র ডাক্তার হবার স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কি না ? নাকি তার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে ! তবে এসব প্রশ্নের জবাব সময়ই বলে দিবে।