
চৌধুরী নজিবঃ
আজ পবিত্র শবে বরাত। হিজরী সনের পবিত্র শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতেই পালিত হয় এই পূণ্যময় রজনীটি। রজনীটিকে আরবিতে লাইলাতুল বরাত বা বন্টনের রজনী বলে অবহিত করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে এই রজনীটি পালন করেন। তবে মুসলিমদের কোনো কোনো দল এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদাতের নির্দেশ নেই বলে মনে করন। এই বিশেষ রজনীর ব্যাপারে কুরআনে সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। অনেকে সূরা আদ-দুখান এর ৩ নং আয়াতে উল্লেখিত “কুরআন অবতীর্ণের বরকতময় রাতকে” শবে বরাত হিসেবে
ব্যাখ্যা করেন। আল্লাহ পাক বলেন “আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।”-(সূরা: ৪৪-দুখান: আয়াত ৩-৪।) তবে অন্যরা সূরা কদরের ১ম আয়াত অনুসারে “কুরআন অবতীর্ণের বরকতময় রাত” দ্বারা শবে কদরকে বুঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআনকে) লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। — সূরা কদরঃ আয়াত ১।সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত
হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। হাদিস শাস্ত্রে ‘শবে বরাত’ বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো “নিসফ শাবান” বা “লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” তথা “শা’বান মাসের মধ্য রজনী”। একটি হাদীসে বলা হয়েছে, আয়িশা (রাঃ) বলেন, এক রাতে আমি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে, তাঁর মাথা আকাশের দিকে তুলে আছেন। তিনি বলেন,
হে আয়িশা! তুমি কি আশঙ্কা করেছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আয়িশা (রাঃ) বলেন, তা নয়, বরং আমি ভাবলাম যে, আপনি হয়তো আপনার কোন স্ত্রীর কাছে গেছেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের মেষপালের পশমের চাইতেও অধিক সংখ্যক বান্দার গুনাহ মাফ করেন।- (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮।) এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী ইবনু আবী সাবরাহকে ইমাম আহমদ, ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত
করেছেন। (ইবনু হাজার , তাক্বরীবুত তাহযীব, পৃষ্ঠা ৬৩২; তাহযীবুত তাহযীব, ১২/২৫-২৬ ।), [সনদ দুর্বল বা বানোয়াট]। আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।- (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর,
২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)[সনদ সহীহ] বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা
রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।”— (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭। [সনদ হাসান] বিশ্বব্যাপী শবে বরাত যেভাবে উদযাপন করা হয়ঃ বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, লেবানন, ইরান, আজারবাইজান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কিরগিজস্তান-এ শবে বরাত উদযাপিত হয়। সালাফি আরবগণ এই দিনটি পালন করে না। আরব বিশ্বে, সুফি ঐতিহ্যের আরবেরা ও শিয়ারা এই উৎসব পালন করে। ইরানে বারো ইমাম শিয়ারা, শিয়া মতবাদের দ্বাদশ ইমাম হজরত ইমাম
মাহদির জন্মদিন হিসেবে এই দিনটি পালন করে। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয়, দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ইরাকে এই দিনে বাচ্চারা প্রতিবেশীর বাড়ি গেলে তাদেরকে মিষ্টিমন্ডা খেতে দেওয়া হয়। ইরাকি কুর্দিস্তান ও আফগানিস্তানের সুন্নি মুসলিমগণ রমযানের ১৫ দিন আগে এই পবিত্রদিন পালন করেন। ইন্দোনেশিয়ায় কিছু মুসলমান মসজিদে উস্তাদ বা জাভা ও মাদুরায় কায়ি নামে পরিচিত ধর্মীয় নেতার বক্তৃতা (সেরামাহ) শোনে ও দলীয়ভাবে জিকির করে ইন্দোনেশীয়ায় এই প্রথা পালিত হয় না বললেই চলে, তবে আচেহ, পশ্চিম সুমাত্রা ও দক্ষিন
কালিমান্তা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পালিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমগণ মিষ্টান্ন বানায় (বিশেষত হালুয়া বা জর্দা) ১৫ই শাবান সন্ধ্যার সময় প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের দেওয়ার জন্য। বসনিয়াতেও শাবানের ১৫তম রাতে হালুয়া বিতরণের এই প্রথা পালিত হয়। সুতরাং এটি একটি মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ রজনী। এই রজনীতে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ, নিজেকে পবিত্র করা ও সৌভাগ্যবানদের খাতায় নিজের নামটি লিপিবদ্ধ করার সুবর্ণ সুযোগ হয়।